থাকছে না ‘ভোটার তালিকা’ এনআইডি আইনের খসড়া

থাকছে না ‘ভোটার তালিকা’ এনআইডি আইনের খসড়া

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন আইনের খসড়ায় ‘ভোটার তালিকা’ প্রসঙ্গটি থাকছে না। জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়নের বিষয়টি আইনের প্রাথমিক খসড়ায় রাখা হয়েছিল। সংবিধান অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রণয়নের একমাত্র এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হওয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের আইনে ‘ভোটার তালিকা’ প্রসঙ্গটি না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইনের খসড়াটি কয়েক দফা পর্যালোচনার পর এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভায় উঠতে যাচ্ছে।

এনআইডি-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করলে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হচ্ছে ওই আইনে। এরই মধ্যে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০২২’-এর খসড়া প্রায় গুছিয়ে এনেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভোটার তালিকা তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ভোটারের বিষয়টি আইনে থাকলে আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। এসব বিবেচনায় আইনটি একেবারে সংক্ষিপ্ত রূপ দেওয়া হচ্ছে। এতে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত গাইডলাইন থাকছে। বিস্তারিত থাকবে আইনের আওতায় প্রণীতব্য বিধিতে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন সংক্ষিপ্ত করতে মন্ত্রিসভা বৈঠকে একাধিকবার নির্দেশনা দেন। সংশ্নিষ্টরা সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে একেবারে মৌলিক বিষয়গুলো আইনের খসড়ায় রাখার চেষ্টা করেছেন।

‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০১০’ অনুযায়ী বর্তমানে এনআইডি দেওয়া হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত কার্যক্রম সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন আইন প্রণয়নের পর নতুন অধিদপ্তর গঠন করে দায়িত্ব বুঝে নেবে সরকার।

প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, ‘সরকার কী বাদ দিল, যোগ করল- সেটা বিষয় নয়। যে কাজটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন করছে, সেটি কেন সরকার নিতে চায়- এটাই বড় প্রশ্ন।’ অনেক দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কাজ করে- সরকারের এমন যুক্তির জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক দেশে অনেক কিছুই নানাভাবে হয়। আমাদের দেশে কি তার সবই হয়? কই, কোনো দেশে তো রাতে ভোট হয় না।’

যা আছে খসড়ায় :আইনের খসড়া অনুযায়ী, একজন নাগরিককে একটি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন নম্বর দেওয়া হবে। যেটা স্ব-স্ব নাগরিকের একক নিবন্ধন নম্বর হিসেবে সব জায়গায় ব্যবহার হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধকের পাঁচটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ‘নিবন্ধককে তথ্য-উপাত্ত, ইত্যাদি সরবরাহ ও সহায়তায় বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক একটি ধারায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দিতে বাধ্য করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নিবন্ধকের চাহিদা অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কমিশন বা সংস্থা উহাদের নিকট সংরক্ষিত তথ্য, কাগজপত্র, ইত্যাদি নিবন্ধককে দিতে এবং দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবে।’ এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০১০-এর আওতায় জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত এবং এ-সংক্রান্ত অনলাইন তথ্যভান্ডার এই আইনের অধীনে নিয়োগ পাওয়া নিবন্ধকের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের দণ্ড হিসেবে সর্বোচ্চ সাত বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অন্য কারও পরিচয়পত্র বহন, পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞাতসারে মিথ্যা বা বিকৃত বা তথ্য গোপন করলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থদণ্ডের কথাও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কী পরিমাণ অর্থদণ্ড হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ অর্থদণ্ডের ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হতে পারে।

এ ছাড়া এই আইনে অভিযোগ, তদন্ত ও বিচার-আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ১৮৯৮ সালের সিআরপিসির বিধান প্রযোজ্য হবে।

চলছে অনু বিভাগ গঠনের কাজ :মন্ত্রিসভায় আইনের খসড়া পাস হওয়ার পর কয়েক ধাপ পেরিয়ে সেটা জাতীয় সংসদে পাস হবে। তবে তার আগেই ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু বিভাগ’ গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এ বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু বিভাগ’ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির জন্য গত রোববার সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হয়েছে। সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু অনু বিভাগ নয়; নিবন্ধন অধিদপ্তরের জনবল কাঠামো নিয়ে কাজ চলছে। সরকার চায়, যত দ্রুত সম্ভব এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম শেষ করতে।

আছে সংশয় :নির্বাচন কমিশন থেকে বর্তমান সরকারের আমলে এনআইডির দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই এ সরকারের বিদ্যমান মেয়াদে এনআইডির নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে যাওয়া কঠিন হবে। এনআইডির নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের সিদ্ধান্তের পর এক বছরের বেশি সময় চলে গেলেও আইন প্রণয়ন হয়নি। সরকারের হাতে থাকা সোয়া বছরের মধ্যে আইন প্রণয়ন ও অধিদপ্তর গঠন করে এনআইডির মতো জটিল একটি কাজ বুঝে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, আইন প্রণয়ন হলেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে না। এনআইডি ভোটার তালিকার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এসেছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিজস্ব জনবলের সঙ্গে প্রকল্পের আওতায় আরও কিছু জনবল নিয়ে কাজটি করছে। এক যুগের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতার পর এনআইডি নিয়ে বহু জটিলতাও রয়েছে। সরকার আইনের ভিত্তিতে অধিদপ্তর গঠন করলেই রাতারাতি দায়িত্ব হস্তান্তর সম্ভব হবে না। একদিকে অধিদপ্তরের বিপুল সংখ্যক জনবল কাঠামোর অনুমোদন নিতে হবে; সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় এবং মাঠ পর্যায়ে আলাদা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এতে বহুপক্ষীয় জটিলতাও আছে।

বাড়তি খরচের চাপ :নির্বাচন কমিশন সারাদেশে থাকা তাদের জনবল এনআইডি-সংক্রান্ত কাজে লাগাচ্ছে। এনআইডির দায়িত্ব সরকারের হাতে গেলে নতুন গঠন হতে যাওয়া অধিদপ্তরেরও একই ধরনের জনবল লাগবে। এ খরচ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যাবে, যা এই সময়ে করা সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, আইনে শব্দগতভাবে যা-ই থাকুক, জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রমের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের একটি সংযোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘অনেক জনবল লাগবে, খরচ তো বাড়বেই।’ জটিলতা বাড়বে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন বলেন, শুরুতে কিছু সমস্যা হতে পারে। আশা করি, পর্যায়ক্রমে সেটা ঠিক হয়ে যাবে।

জাতীয়