সংসারের বাজেটে কাটছাঁট নিম্ন-মধ্যবিত্তের টিকে থাকার লড়াই ‘পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয়ে ঘটতির কারণে খাবারের ব্যয় কমানো মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে। জ্বালানি তেলের পর নতুন করে গ্যাস-বিদু্যতের দাম বাড়লে তা এ কোটাও ছাড়িয়ে যাবে’

সংসারের বাজেটে কাটছাঁট নিম্ন-মধ্যবিত্তের টিকে থাকার লড়াই ‘পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয়ে ঘটতির কারণে খাবারের ব্যয় কমানো মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে। জ্বালানি তেলের পর নতুন করে গ্যাস-বিদু্যতের দাম বাড়লে তা এ কোটাও ছাড়িয়ে যাবে’

রাজধানীর দিলকুশায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক নজিবুর রহমান। পলস্নবী থেকে প্রতিদিন বাসে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন। তার তিন সন্তানেরও স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া গণপরিবহণেই। নতুন বাস ভাড়ায় তাদের এখন শুধু যাতায়াত বাবদই মাসে অতিরিক্ত সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হবে। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচও বেশ অনেকটা বাড়বে। তাই নিম্ন-মধ্যবিত্ত এ সংসারের ছোট বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই নজিবুর রহমান সংসারের মাসিক খরচের হিসাব থেকে তিন সন্তানের টিফিনের জন্য বরাদ্দ টাকা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি তিন বেলা খাবারের খরচ আরও কীভাবে কমানো যায় সে পথ খুঁজছেন। অগ্নিমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক শহীদুল হক তার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। এর ওপর সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর নতুন করে বাসভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অসহায় এ গৃহকর্তা পরিবারের খাবারের তালিকা থেকে মাছ-মাংসসহ অনেক কিছুই বাদ দিয়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন। শুধু নজিবুর রহমান কিংবা শহীদুল হকই নন, তাদের মতো লাখ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের সংসারের খাবারের ছোট বাজেট কাটছাঁট করে আরও ছোট করার চেষ্টা করছেন। সংসারের খরচের হিসাবে বারবার কাঁচি চালাতে গিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অথচ এরই মধ্যে নতুন করে গ্যাস-বিদু্যতের দাম বাড়ানোর কথা উঠেছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে সংসারের খরচ আরও এক ধাপ বাড়বে। তাই নিম্ন-মধ্যবিত্তরা এখন কোনো রকমে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে নতুন করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিগত সময় আর্থিক অনটনে নিম্নবিত্ত মানুষের পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও শহরের তুলনায় সেখানে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ায় সে চিন্তাও বাদ দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয়ে ঘটতির কারণে খাবারের ব্যয় কমানো মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে। জ্বালানি তেলের পর নতুন করে গ্যাস-বিদু্যতের দাম বাড়লে তা এ কোটাও ছাড়িয়ে যাবে। তারা জানান, চলতি বছরের মার্চের শেষভাগে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) জরিপ অনুযায়ী আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে খাবারের ব্যয় কমানো মানুষের হার ছিল ৪৩ শতাংশ। যা পরবর্তী চার মাসে ধাপে ধাপে বেড়ে ৫০ শতাংশে ঠেকেছে। সিপিজের ওই জরিপে জানানো হয়েছিল, গত বছরের জুনে যেখানে ৬৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন তাদের আয় কমেছে, সেখানে ডিসেম্বরে হারটি দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি পরিবারের আয় আগের পর্যায়ে ফেরেনি। ওই দিকে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। জরিপে গত ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ পরিবার যেমন খাবার কেনাকাটায় খরচ কমানোর কথা জানিয়েছে, তেমনি ৩৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা কম মজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন। সঞ্চয় থেকে খরচ করেছেন ২৬ শতাংশ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে গত বছর জুনে ঋণ নিয়েছে ৬৬ শতাংশ পরিবার। ডিসেম্বরে এ হার ৩৪ শতাংশে নামে। ডিসেম্বরেও যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশ সেই টাকা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনেছেন। এক-চতুর্থাংশ আগের ঋণ পরিশোধ এবং কিছু অংশ ওষুধ কেনা ও চিকিৎসার খরচ চালানো ইত্যাদি কাজের জন্য খরচ করেছেন। তাদের ঋণ নেওয়ার উৎস হচ্ছে মহাজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। ঋণের বিষয়ে সিপিজের গবেষকদের ভাষ্য, নতুন করে ঋণ নেওয়ার হার কমেছে, তার মানে এ নয় যে ওই ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানিয়েছিল, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ, যা করোনার আগে ২১ শতাংশের মতো ছিল। যদিও সরকার নতুন দরিদ্রের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, দ্রম্নত সরকারের নিজস্ব একটি জরিপ করা উচিত। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে না।’ সিপিজের জরিপ নিয়ে তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। ফলে মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এদিকে ভুক্তভোগীরা জানান, করোনা মহামারির সময় এমনিতেই তাদের আয়-উপার্জন যথেষ্ট কমেছে। অনেকে নিয়মিত পেশা থেকে ছিটকে পড়ে কোনো রকমে বিকল্প পথে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছেন। এ সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বাসভাড়া ও পণ্য পরিবহণ খরচ বেড়েছে। চালসহ সব খাদ্য ও নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামহীন পাগলা ঘোড়া হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে তাদের সংসারের অপরিহার্য খরচ মেটানো এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার খাবারের মান ও পরিমাণ কমিয়ে বাড়তি খরচ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউবা ভাড়া বাসায় সাব-লেট দিয়েছেন। শহরকেন্দ্রিক মধ্যম মানের আবাসিক এলাকার বাসা ছেড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ উপকণ্ঠ এলাকায় সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে রিকশা কিংবা অন্য কোনো গণপরিবহণে না চড়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি অনেকে চিকিৎসা সেবার বাজেটও কাটছাঁট করেছেন। তাদের এ বক্তব্য যে অমূলক নয়, তা নগরীর মুদি দোকানি, বাড়ি মালিক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মালিবাগ বাজারের সুমনা জেনারেল স্টোরের মালিক আব্দুস সাত্তার জানান, যারা তার দোকান থেকে মাসিক বাজার করেন, তাদের বেশিরভাগ কাস্টমারই আগের তুলনায় চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য পরিমাণে কম নিচ্ছেন। আগের খরচের সঙ্গে বর্তমান খরচের সমন্বয় করতে অনেকে চিকন চালের পরিবর্তে মোটা চাল, উন্নত ডালের পরিবর্তে মাঝারি মানের ডাল কিনছেন। বেশিরভাগ কাস্টমারের বাজারের তালিকা থেকে বিস্কুট, চানাচুর, ওভালটিন, নসিলা ও হরলিক্সসহ এ ধরনের অধিকাংশ পণ্য উধাও হয়ে গেছে। অনেকের প্রসাধনী সামগ্রীর তালিকাও ছোট হয়ে এসেছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ডক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এখন যা পরিস্থিতি তাতে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও বাড়বে। তার ভাষ্য, যারা নিম্ন আয়ের তাদের খাদ্য কেনার সামর্থ্যই কম। এখন দেখা যাবে আয়ের ৯০ ভাগই খাদ্য কিনতে ব্যয় করতে হবে। তাতেও সে পর্যাপ্ত খাদ্য পাবে না। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত খাদ্য ব্যয় বাড়াতে পারবে। এর আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব আছে নন ফুড আইটেমের ওপর। মানুষ ফ্রিজ, টেলিভিশনের মতো আরও অনেক জিনিস কেনা কমিয়ে দিচ্ছে। যার প্রভাব এই ধরনের শিল্পে এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এটাও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কনজু্যমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ এই সরকারের উদ্যোগগুলো ব্যবসায়ীবান্ধব, জনবান্ধব নয়। বাজারে চাল, তেলসহ অনেক পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব সিন্ডিকেট ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এস এম নাজের হোসেন বলেন, দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ তার আয়ের ৭০ ভাগ খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। এখন যেটা হচ্ছে এই ব্যয় বাড়ানোর মতো অর্থ তাদের হাতে না থাকায় তারা খাবার কেনা কমিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। খাবার কম খাচ্ছে। এটা দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়বে। তারা অপুষ্টিতে ভুগবেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য অর্থনীতিবিদ ডক্টর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যদি আয় না বাড়ে তাহ

অর্থ বাণিজ্য জাতীয়