সংসার চালাতে আর কোথায় কোথায় ব্যয় কমানো যায়, সেটিই এখন প্রতিদিনকার ভাবনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কবীর হোসেনের। গত তিন বছরে মাসিক বেতন ৪০ হাজার টাকা থেকে এক টাকাও বাড়েনি। অথচ খাদ্যপণ্য, যাতায়াত, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সব খাতে এই তিন বছরে ব্যয় বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়েই ব্যয় কমানোর জায়গা খোঁজেন তিনি।
এক্ষেত্রে তিনি তিন বেলার আহার জোগানোর ব্যয়েই বেশি ছুরি-কাঁচি চালিয়েছেন। খাদ্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের মতো দামি পণ্য কেনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বাজারে গেলে এখন তিনি তার চাহিদার অর্ধেক পণ্য কেনেন। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এ সপ্তাহে নতুন করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন অর্ধেক পণ্য কিনেও আর কুলাচ্ছে না অর্থে, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে পকেট। আর কোথায় তিনি ব্যয় কমাবেন সে জায়গাও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্কুলান না হওয়ায় দিশেহারা কবীর হোসেন। শুধু কবীর হোসেন নন, তার মতো মধ্যবিত্ত প্রতিটি পরিবারের কর্তাব্যক্তির এখন একই দশা।
সমাজবিজ্ঞানী ও বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের উচ্চবিত্ত আর একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষের চেয়ে সবচেয়ে কষ্টে আছে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরা।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, চালের কেজি ৫০০ টাকা হলেও সমাজের উচ্চবিত্ত বা ধনীদের কোনো সমস্যা হবে না। চালের কেজি কত, তেলের কেজি কত, মাছের কেজি কত, মাংসের কেজি কত- তারা বাজারে এসবের খোঁজও রাখেন না। কারণ তারা বাজারে যান না। আর গরিব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে হাত পাততে কিংবা ভিক্ষা করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মধ্যবিত্তের পক্ষে এর কোনোটিই করা সম্ভব নয়। ফলে মধ্যবিত্তরা এখন ডুকরে কাঁদছে, তারা নীরবে চোখের পানি ফেলছে। মধ্যবিত্তের এই দুর্দশার জন্য দেশের সমাজব্যবস্থা এবং সরকারের উদাসীনতাই দায়ী।
ভোগ্যপণ্যের চড়া মূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়তে থাকে মহামারি করোনার শুরু থেকেই। মূলত সে সময় থেকেই দেশের বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এরপর গত তিন বছরে দফায় দফায় দাম বাড়তে বাড়তে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম একেবারে আকাশচুম্বী হয়েছে। অধিকাংশ পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে ভোগ্যপণ্যের দামের আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়েছে। একদিকে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে, আরেক দিকে এই অজুহাতকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত মুনাফা লুটতে উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে চাল, ডাল, সবজি, মাছ ও মুরগি থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম আবারও বেড়ে গেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা কবীর হোসেন শুক্রবার বাজার করতে এসেছিলেন, রাজধানীর কল্যাণপুর নতুনবাজারে। ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রথমে তিনি মাছের বাজারে ঢোকেন। প্রথমে তিনি পুরো বাজারটি ঘুরে দেখেন এবং কোন মাছের কী দাম জিজ্ঞেস করেন। ইলিশ মাছের ঝুড়ির সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সামনে এগোলেন। শেষমেশ তিনি এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনে হাঁটা দিলেন সবজির বাজারের দিকে। সবজির বাজারে ঘুরে অল্পবিস্তর সবজি কিনলেন। সবজি কেনা শেষেই কবীর হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
বাজারে এসে কী কিনলেন জানতে চাইলেই তিনি কিছুটা বিরক্ত। উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, কেন ভাই- আমি কী কিনলাম সেটি আপনার জানার কী দরকার। পরিচয় দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম- আসলে এই চড়া মূল্যের বাজারে কীভাবে সামলাচ্ছেন, কীভাবে সংসার চলছে। তখন তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বললেন।
কবীর হোসেন বলেন, আমার ছেলেমেয়ে ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করে। এ জন্য মাছের বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মাঝারি আকারের ইলিশের কেজি চাচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আমি বাজারে এসেছি দেড় হাজার টাকা নিয়ে। ভাবলাম যদি এক কেজি ইলিশ কিনি তা হলে তো অর্ধেক টাকা শেষ। তাই বাধ্য হয়ে ইলিশ না কিনতে পারার কষ্ট বুকে চেপে চলে গেলাম। পরে ১৬০ টাকা কেজিতে এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনে চলে এলাম। আসলে ইলিশ কিনতে না পারায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম, চোখে পানি চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল আমি কেমন বাবা সন্তানের পছন্দের মাছটি আমি কিনতে পারলাম না। অর্থাৎ আমি কম দামের মাছ কিনে অর্থ সাশ্রয় করছি। এভাবে সবজি, তেল, চাল-ডালসহ সব পণ্যের ক্ষেত্রেই কখনও কম দামের পণ্য কিনে আবার কখনও অর্ধেক পণ্য কিনে ঘরে ফিরছি। এভাবে কত দিন টিকে থাকতে পারব জানি না। তা ছাড়া আর কোথায় ব্যয় কমাব, আর কত কাটছাঁট করব। সংসারের ব্যয় মেটাতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছি, আর পারছি না।’
জ্বালানি তেল পণ্যের চড়া মূল্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিল
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সবার আগে প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। কারণ সব পণ্যই উৎপাদক থেকে বিক্রেতার হাত ঘুরে ভোক্তার ব্যাগে উঠতে পরিবহনের দরকার। আর এই পরিবহন চলে জ্বালানি তেলে। তাই জ্বালানি তেল পণ্যের চড়া মূল্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের কারণে নতুন করে দাম বাড়ল বাজারের সব ধরনের পণ্যের।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। টমেটোর দাম কেজিতে একলাফে বেড়েছে ৪০ টাকা। টমেটো এখন ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এক সপ্তাহে ৪০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা ছুঁয়েছে। শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেড়েছে। বর্তমান দাম ২০০ টাকা কেজি। শুধু ব্রয়লার মুরগিই নয়, বেড়েছে পাকিস্তানি কক-মুরগির দামও। গত সপ্তাহেও পাকিস্তানি ককের দাম ছিল ২৪৫-২৫০ টাকার মধ্যেই। গতকাল কক বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ২০০ টাকা। তবে কেউ কেউ ১৯০ টাকা কেজিও বিক্রি করছেন। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা কেজি।
অন্যদিকে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও। ডজনে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। প্রথমবারের মতো ফার্মের মুরগির একডজন ডিমের দাম ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় উঠেছে। আর মুদি দোকানে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ডিমের ডজন ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা।
রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার ব্যবসায়ী রবিউল করিম বলেন, গত সপ্তাহে একডজন লাল ডিম ১২৫ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন ১৪৫ টাকা বিক্রি করছি।
এ ছাড়া বাজারে খোলা সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে খোলা সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হয়েছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। গতকাল বিক্রি হয় ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায়। বোতলজাত সরিষার তেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়। বেড়েছে পাম অয়েলের দামও। গত সপ্তাহে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে ১ কেজি পাম অয়েল। গতকাল শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।
গত এক সপ্তাতে চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে এখন ৫২ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। নাজির ও মিনিকেট চালের দামও বেড়েছে কেজিতে ৩-৫ টাকা। গত সপ্তাহে ৭৫ টাকা কেজি দরের চিকন চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। শুধু তা-ই নয়, ‘গরিবের মোটা চাল’ এখন ৫২-৫৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এই চালের দাম ছিল ৫০ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি দরে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৬ টাকা।
বাজারে বেশিরভাগ সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। বাজারে শসা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। লম্বা বেগুন ৯০ আর গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০, করলা ৭০, চালকুমড়া পিস ৫০, প্রতি পিস লাউ আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০, মিষ্টিকুমড়ার কেজি ৫০, চিচিঙ্গা ৬০, পটোল ৬০ , ঢেঁড়স ৭০, কচুর লতি ৮০, পেঁপের কেজি ৫০, বরবটির কেজি ৮০, ধুন্দলের কেজি ৬০ ও কাঁচামরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়।
বাজারে আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। পেঁয়াজের দাম কমেছে, কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। আর একটু ভালোমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। এসব বাজারে রসুনের কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বাজারে চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। আদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়।
বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৭ আর প্যাকেট চিনি ৯২ টাকায়। এ ছাড়া এসব বাজারে দেশি মসুর ডালের কেজি ১৪০ ও ভারতীয় মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। প্যাকেট আটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ এবং খোলা আটা ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। ভোজ্য তেলেও কোনো সুখবর নেই। প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২০৫ টাকা। এসব বাজারে লাল ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। হাঁসের ডজন ২১০ থেকে ২২০ আর দেশি মুরগির ডিমের ডজন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৭০০ আর খাসির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়।
বাজারে রুই মাছ কেজি ৩২০ থেকে ৪৫০, তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ ১৬০ থেকে ১৯০, শিং মাছ ৩৫০ থেকে ৪৬০, কৈ মাছ ২০০ থেকে ২৫০ ও পাবদা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে ইলিশও। এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০, যা গত সপ্তাহে ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।