সূর্যের উত্তাপ থাকবে চূড়ান্ত, উইকেট পাথরের মতো শক্ত। অস্ট্রেলীয় গ্রীষ্মের এই ছবির সঙ্গেই পরিচিত ক্রিকেট বিশ্ব। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোথায় সেই অস্ট্রেলিয়া?
হোবার্ট, মেলবোর্ন, পার্থ, অ্যাডিলেডে সূর্যের দেখা মিলছে কালেভদ্রে। বৃষ্টি আর মেঘের দাপটে সূর্য তাপই ছড়াতে পারছে না। এই কন্ডিশনের সুবিধাটা দুহাত ভরে নিচ্ছেন পেসাররা। ব্যাটসম্যানরাও রানের খোঁজে হাপিত্যেশ করছেন। প্রমাণ আছে পরিসংখ্যানেও। এবারের বিশ্বকাপে ওভারপ্রতি রানরেট অতীতের সব বিশ্বকাপের চেয়ে কম (৭.৩৬)।টি-টোয়েন্টির এটি অষ্টম বিশ্বকাপ, প্রথমবারের মতো আয়োজক অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু যে সময় বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো হচ্ছে, তা ঠিক টি-টোয়েন্টিসুলভ নয়। অস্ট্রেলিয়ায় এ সময় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তো দূরের কথা, ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ বিগ ব্যাশও শুরু হয় না। এবারের বিগ ব্যাশ যেমন শুরু হবে ১৩ ডিসেম্বর। সে সময় অস্ট্রেলীয় গ্রীষ্মের চেনা চেহারাটা দেখা যায়। মেলবোর্ন, সিডনি ও ব্রিসবেনে তখন বয়ে যায় রানবন্যা। অস্ট্রেলিয়ার এই তিন ভেন্যুতেই সবচেয়ে বেশি রান হয়। মেলবোর্নে যেমন প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ১৭৫। সিডনিতে তা ১ রান বেশি (১৭৬), ব্রিসবেনে একটু কম (১৬২)।এবারের বিশ্বকাপে এই গড় স্কোর বলতে গেলে ছোঁয়াই হচ্ছে না। সিডনির আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো বলে সেখানে দুটি দুই শ রানের ম্যাচ হয়েছে। তবে সেখানেই আবার রান তাড়ায় এক শর ঘরে অলআউটের ঘটনাও আছে। অন্য সব ভেন্যুতেই রানের আকাল। প্রতি মৌসুমের শুরুতে নাকি এমনই হয়। বিগ ব্যাশকে গ্রীষ্মের মাঝে জায়গা দিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট শেফিল্ড শিল্ড শুরু হয় অক্টোবরে। আর প্রতি মৌসুমেই শিল্ড দলগুলো রানখরা নিয়ে অভিযোগ করে। এবার শিল্ড ব্যাটসম্যানদের মতো অবস্থা হয়েছে বিশ্বকাপ খেলতে আসা ব্যাটসম্যানদের।
এর সঙ্গে যোগ করুন আরেকটি তথ্য। কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিটি দলেরই পেস বোলিং সামর্থ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে সেই পেসাররা গ্রীষ্মের শুরুর তাজা ঘাসের উইকেট পাচ্ছেন, যা সিম বোলিংয়ের জন্য বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্যের হাত। মেঘলা আবহাওয়ার কারণে থাকছে সুইংও। আর অস্ট্রেলিয়ার চিরায়ত বাউন্স তো আছেই। বোলাররাও তাই নতুন বলে টেস্ট ম্যাচ লাইন-লেংথ বোলিং করেই সাফল্য পাচ্ছেন।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ দলের পেসার তাসকিন আহমেদ এটাই বলেছিলেন প্রতিক্রিয়ায়, ‘উইকেটে সাহায্য ছিল যথেষ্ট, যে কারণে আমি টেস্ট ম্যাচ লাইনে বল করেছি।’ ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের পর বলেছেন, ‘প্রথম পাঁচ-ছয় ওভার দেখে মনে হয়েছে টেস্ট ম্যাচ খেলছি। কারণ, বল অনেক মুভ করছিল। আর ক্যারিও ছিল যথেষ্ট।’ আফগান অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী নিয়মিত বিগ ব্যাশ খেলেন। পার্থক্যটা তাই তাঁরই ভালো বোঝার কথা। তা নবী কী বলছেন? তিনি বলছেন, ‘বিগ ব্যাশের সময় উইকেট আরও শুষ্ক থাকে। বল এক-দুই ওভার সুইং করে। এরপর ব্যাটিং স্বর্গ। লেগ স্পিনেরও একটা রোল থাকে। কিন্তু এবারের মতো সুইং থাকে না।’
নতুন কুকাবুরা বলও রান কম হওয়ার একটা কারণ। ২০২০-২১ গ্রীষ্ম থেকে টেস্ট ক্রিকেটে নতুন কুকাবুরা বল ব্যবহার হচ্ছে। ডিউক বলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ায় কুকাবুরা তাদের সিম পরিবর্তন করেছে। নতুন কুকাবুরার সিম আগের তুলনায় খাড়া হওয়ায় পেসাররা বাড়তি সুবিধা পান। গত বছর সেই লাল বলের ডিজাইনে সাদা বলও তৈরি করা শুরু করেছে কুকাবুরা। যে কারণে সাদা বলেও সিম ও সুইং হচ্ছে বেশি।সিম উন্নত হওয়ায় সুইংয়ের পাশাপাশি ওবল সিমও চলে এসেছে সাদা বলের ক্রিকেটে। বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার আনরিখ নরকিয়া ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ওবল সিমে সৌম্য সরকারকে আউট করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক নতুন বলে সুইং করানোতে বিখ্যাত। তিনি এখন সুইং বাদ দিয়ে ঝুঁকছেন ওবল সিমের দিকে। এসবের সমন্বয়েই ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে বলের গড় মুভমেন্ট গত ১০ বছরের তুলনায় এ বছরই সর্বোচ্চ (১.৫১)।
এসব কারণ তো দৃশ্যমানই। এর সঙ্গে বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের অদৃশ্য চাপটা যোগ করে নিন। যোগ করুন অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি খেলায় অন্য দলগুলোর অনভিজ্ঞতাও। ইংল্যান্ড ও ভারতের বাইরে অন্য দলগুলো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দ্বিপক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলার সুযোগ পায় না বললেই চলে। এ ছাড়া ২০ ওভারের বড় বড় প্রতিযোগিতার সবই হয় এশিয়ায়। চার-ছক্কায় ভরপুর যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা সবাই দেখে অভ্যস্ত, অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে ক্রিকেটারদের খেলার অভিজ্ঞতা কম, সেটা একটু কঠিনই।
সবকিছু মিলিয়েই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চলছে পেসারদের রাজত্ব।