অবৈধ ক্লিনিকে চিকিৎসা বাণিজ্য

অবৈধ ক্লিনিকে চিকিৎসা বাণিজ্য

রাজধানীর রূপনগরে লাইসেন্স ছাড়াই চিকিৎসা-অপারেশন চালিয়ে আসছে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতাল। হাতের আঙুলে অস্ত্রোপচারের সময় মারা যায় কুড়িগ্রামের ছয় বছর বয়সী শিশু মারুফা জাহান মাইশা। এরপর বেরিয়ে আসে হাসপাতালটিতে অনুমোদন ছাড়াই চলছিল সব চিকিৎসা কার্যক্রম। আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এ রকম প্রায় ৪ হাজার ৫০০ অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক। গত সেপ্টেম্বরে আলটিমেটাম দিয়ে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। দফায় দফায় অভিযানে এ বছর সর্বোচ্চ হাসপাতাল-ক্লিনিক নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু এরপর থমকে আছে অভিযান। এ সুযোগে অনেকেই আবার ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক খুলে বসছে।

আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালের ঘটনায় নিবন্ধনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবা দেওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের নোটিসে বলা হয়েছে, নিবন্ধনহীন এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা দিলে দায়ভার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে বহন করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বিষয়টি জানতে পারলে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৬টি। কিন্তু কয়েক দফা আলটিমেটামের পরও এখনো নিবন্ধনের আবেদন করেনি প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ব্লাডব্যাংক। গত সেপ্টেম্বরে অভিযানের পর নতুন করে নিবন্ধনের আবেদন করেছে আরও ২ হাজার ২০৩টি ক্লিনিক। স্বাস্থ্য অধিদফতর নড়েচড়ে বসলেই আবেদনের হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু অভিযান থেমে গেলেই ক্লিনিকের নামে দোকান খুলে বসে এসব অপরাধী চক্র।
অবৈধ হাসপাতাল, ব্লাডব্যাংক বন্ধ করে গত জুন-আগস্টে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এ সময়। মে মাসে অভিযানের পর প্রথম কয়েক দিন লাইসেন্স নবায়ন করার, নতুন লাইসেন্স নেওয়ার যে তোড়জোড় ছিল তা এখন ধীরগতি হয়ে গেছে। এর আগে গত ২৬ মে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সারা দেশের সব অবৈধ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ নির্দেশনার পর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সারা দেশে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ হাজার অবৈধ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জুন-আগস্টে নতুন রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এসেছে ১ হাজার ১০৩টি প্রতিষ্ঠান ও লাইসেন্স পুনঃনবায়ন করেছে ২ হাজার ১৮১টি প্রতিষ্ঠানে। নতুন লাইসেন্সের জন্য ২ হাজার ৩৩৯টি আবেদন জমা পড়েছে। লাইসেন্স পুনঃনবায়ন করার জন্য ৪ হাজার ৫৯৮টি আবেদন জমা পড়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে অথচ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব শর্ত মানছে না, পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সারা দেশে অভিযান পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার। বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় সরাসরি অভিযান পরিচালনা করে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া কিংবা জরিমানা করতে পারে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাই অভিযান পরিচালনা করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা জেলা প্রশাসকের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। সবকিছুর সমন্বয় করে সারা বছর অলিগলিতে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে পারে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘হাসপাতাল পরিদর্শন, অভিযান এগুলো আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম। শুধু অবৈধ হাসপাতাল নয় নিবন্ধিত হাসপাতাল কোনো অনিয়ম করলে আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিই। তাদের সতর্ক করা ও কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। তবে জনবল অপ্রতুল হওয়ায় সবসময় হয়তো দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখা সূত্রে জানা গেছে, লাইসেন্স নিয়ে ১৯৮২ সাল থেকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে একবার নিবন্ধন নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আর তা নবায়ন করেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান শুরুতে ১০ শয্যার অনুমোদন নিলেও পরে শয্যা বাড়ালে তা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানায়নি। অনেকে শয্যার সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়ায়নি জনবল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে এসব প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্য