২২০ টাকা দামের সাধারণ মানের এক জোড়া স্যান্ডেলে ৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) ধার্য থাকায় ক্রেতাকে পণ্যের মূল্য হিসেবে ১১ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায়, ভ্যাট আরোপ না থাকলে এই পণ্যের দাম হতো ২০৯ টাকা। এভাবে শুধু ভ্যাটের কারণে সাধারণ মানুষকে পণ্য কিনতে প্রতিনিয়ত গুনতে হচ্ছে বাড়তি মূল্য।
পণ্যের দাম বাড়ায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, করোনার মত বড় ধরনের স্বাস্থ্য ব্যাধি, অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন অনেকে। তবে অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা, এসব কারণের সঙ্গে পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ভ্যাটের বাড়তি হারকেও যোগ করেছেন।
পলিসি টিচার্স ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আয়কর আদায়ে এনবিআর আগের চেয়ে ভালো করলেও এখনো সফল হতে পারেনি। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সম্পদশালীরা আয়করের আওতার বাইরে রয়েছে। অন্যদিকে ভ্যাট যোগ করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। যা ক্রেতা নিজের অজান্তে পণ্যের মূল্য হিসেবে পরিশোধ করে থাকে। তাই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভ্যাট খাতকে বেছে নিয়েছে এনবিআর।
ধনী দরিদ্র সবাইকে একই হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। কোনো পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়ালে শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে সম্পদশালীদের জীবনযাত্রায় প্রভাব না পড়লেও ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ আয়ের মানুষ।
প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাজেট বাস্তবায়নের প্রায় ৬০ ভাগ অর্থ জোগাড়ের দায়িত্ব থাকে এনবিআরের ওপর। এনবিআরের সর্বশেষ হিসেবে ৮২লাখ ১ হাজার ৯৭৩ জন অন লাইনে ইটিআইএন গ্রহণ করেছে। পিআরআই এর তথ্যমতে ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে আয়করের আওতায় ৫ কোটি মানুষ থাকা খুব স্বাভাবিক।
করের আওতা বাড়াতে বিগত দিনে আয়কর আইনে নতুন নতুন ধারা যুক্ত করে রাজস্ব ফাঁকিবাজ সম্পদশালীদের কাছ থেকে সঠিক হিসেবে রাজস্ব আদায়ে এনবিআর উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের সমাজে সম্পদশালীরা প্রভাবশালী হয়ে থাকে। এদের সঙ্গে সরকারের নিতি নির্ধারণী পর্যায়ে অনেকের সঙ্গেই ভালো যোগাযোগ থাকে। শেষ পর্যন্ত এসব সম্পদশালীদের তদবির সুপারিশে রাজস্ব ফাঁকিবাজদের আটকাতে আয়কর আইনের ধারাগুলি বাতিল করতে বাধ্য হতে হয়।
উদাহরণ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বহু বছর থেকে সম্পদকর আরোপে এনবিআরকে উদ্যোগ নিতে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠে না। সম্পদ কর আরোপ হলে প্রকৃত সম্পদ অনুযায়ী কর দিতে বাধ্য হতে হবে। অন্য দিকে বাড়ি ভাড়া ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে গ্রহণে আইন করেও শেষ পর্যন্ত বাতিল করে এনবিআর।
অন্যদিকে এনবিআরের সক্ষমতার অভাবেও এনবিআর আয়করের আওতা বাড়াতে পারছে না। ২০১১ সাল থেকে উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের দপ্তর স্থাপন করে রাজস্ব প্রদানে সক্ষম করদাতা খুঁজ বের করার কথা থাকলেও এখনো এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
নব্বই দশকে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ভ্যাট ব্যবস্থার বাতিলের দাবিতে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামলেও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে সরকার কঠোরভাবে ভ্যাট ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন।
এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, চলতি অর্থ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ভ্যাট ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা এবং আয়কর ভ্যাটের চেয়ে কম ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়। এর আগের বছর মোট রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার মধ্যে ভ্যাট ১লাখ ৮ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা এবং আয়করের পরিমাণ আগের বছরের মতই ভ্যাটর চেয়ে কম ছিল।