অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েনি। বৈশ্বিক অর্থনীতি স্মরণকালের ভয়াবহ সময় পার করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনা মহামারির চেয়ে তীব্র সংকটকাল অতিক্রম করছে। ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতি।যদিও গত দুই মাসে সামান্য কমেছে। ১১ মাসে টাকার মান যে হারে কমেছে, তা এর আগে কখনই হয়নি। ৮৮ টাকার ডলার গিয়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। এখনো এর ব্যাংক রেট ১০০ টাকার বেশি।গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া এই ডলার সংকট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ সংকট কাটাতে বিলাসী পণ্যের আমদানি শূন্যে নামিয়ে আনলেও খুব একটা কাজ হয়নি। এখন নিত্যপণ্য আমদানির এলসি খোলাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে এসব জরুরি পণ্য আমদানির এলসি খোলার জন্য।এতেও সমস্যার কতটুকু সমাধান হবে তা হয়তো বোঝা যাবে বাজারের অবস্থার দিকে তাকালে। তবে এ জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। সামনে মার্চ-এপ্রিলে রমজান মাস। মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। বছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য এটা একচুয়্যাল হিসাবে আরও কম। যেখানে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের ৮ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনেক দিন ধরেই বিশ্ব মানদন্ড অনুযায়ী এটা বাদ দিয়ে রিজার্ভ হিসাব করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের যে আলোচনা চলছে সংস্থাটির সঙ্গে, সেটা পেতে হলে মানতে হবে এই শর্তও। কাগজে-কলমে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে তা সামান্যই। গত কয়েক বছরে রপ্তানির নতুন বাজার ধরতে পারেনি ইপিবি। আর মূল্যস্ফীতির চাপে রেমিট্যান্সের অর্থের একটা বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে মানুষকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকে থাকা আমানত তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। যদিও এটাকে ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থার সংকটের প্রভাব বলে মনে করেন সাবেক
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে তা সামান্যই। গত কয়েক বছরে রপ্তানির নতুন বাজার ধরতে পারেনি ইপিবি। আর মূল্যস্ফীতির চাপে রেমিট্যান্সের অর্থের একটা বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে মানুষকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকে থাকা আমানত তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। যদিও এটাকে ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থার সংকটের প্রভাব বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কতগুলো জায়গা রয়েছে যেগুলো দেখলে বোঝা যায় অর্থনীতি কেমন যাচ্ছে। এর অন্যতম একটি সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। যা মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। এতে মানুষ ভোগের মাত্রা কমাতে বাধ্য হয়। যা এখনো চলমান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা বোঝাটা বেশ মুশকিল। কারণ এখানে অনেক তথ্যের গরমিল রয়েছে। এমনকি জনসংখ্যার হিসাব ও জনসংখ্যার দৈনন্দিন চাহিদার হিসাবের মধ্যেও ফারাক রয়েছে। মূল্যস্ফীতি আর জিডিপি একই সময়ে বাড়তে পারে না। এটা কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখানে সেটা হয়েছে। তবে এটা বোঝা যায় অর্থনীতিতে ভাটির টান রয়েছে- এমনটা মনে করেন সাবেক তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। কেননা মানুষের আয় বাড়েনি। অথচ জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আবার মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রহীনভাবে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও সমস্যা রয়েছে। সেটাকে আগে ঠিক করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। ৮ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১২ কোটি ডলার পরিশোধের পর ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে রিজার্ভ। এখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে। আর কিছুদিনের মধ্যে রিজার্ভ সংরক্ষণে নতুন হিসাব অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে অর্থনীতির সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। যা ১১ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। তবে সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে আগের মাস নভেম্বরের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। যা নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। ফলে এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে দেশে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ২০২২ সালে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। তবুও সংকট কাটেনি। উল্টো এর ফলে টাকার চাহিদা বেড়েছে। কেননা টাকার মান কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আগে যে জিনিস ১০০ টাকায় কেনা যেত সে জিনিস কিনতে এখন অতিরিক্ত আরও ১০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ফলে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ফলে গত বছরের শুধু নভেম্বর মাসেই ব্যাংক খাতের আমানত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা কমেছে। এ প্রসঙ্গে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা যদি এ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পারি তবে সমস্যা আরও বাড়বে। নতুন বছরে একেবারে ঘুরে দাঁড়াতে পারব এমন কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি। কেননা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া যদি সঠিকভাবে না এগোয় তাহলে তো সংকট সমাধান হবে না। মোট কথা, গত এক দশকে আমাদের ছোট ছোট অনেক সমস্যা ছিল, যা ২০২২ এসে একত্রে বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।