মুঈদ রহমান
দেশের রাজনীতিতে চলছে নির্বাচনি হাওয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। তবে পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক ধারায় এগোচ্ছে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান, প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতাসীন দল বর্তমানে প্রচলিত সরকারি দলের অধীনেই নির্বাচন করার পক্ষে অনড়। অন্যদিকে বিরোধী দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরই মধ্যে বিএনপি বিভাগীয় পর্যায়ের গণসমাবেশ সম্পন্ন করে নতুন কর্মসূচিতে আছে। এরই অংশ হিসাবে গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে পদযাত্রা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি ঢাকায় চারদিনের এ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ কর্মসূচির বিরোধিতা করে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সাবধানিবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, আগামী সাধারণ নির্বাচনকে অর্থবহ করে তোলার কোনো ইঙ্গিত এ দুই দলের কর্মকাণ্ড বা আচার-আচরণ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই অর্থে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে আগামী নির্বাচন।
রাজনীতির বাইরে অর্থনীতির কোনো স্বতন্ত্র অবস্থান নেই। অর্থনীতি রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। যদি কোনো দেশের রাজনীতিতে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তাহলে সেদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে বাধ্য। কোনো দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে সেদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। অর্থনীতিতে এ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় দেখা যায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও বণ্টনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে অর্জিত সমৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে না। গত ৫০ বছরে আমাদের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেনি তা নয়; অবশ্যই ঘটেছে। কিন্তু তার সুফল ভোগ করেছে এবং করছে অল্পসংখ্যক মানুষ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র দুজন কোটিপতি নিয়ে। বর্তমানে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা সরকারি হিসাবেই ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আমাদের অর্থনীতির বাগানে ফল ধরেছিল এবং ধরছে, তবে তা অল্পসংখ্যক মানুষের ভোগে যাচ্ছে। তাই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন না করে শুধু শাসকের পরিবর্তনের পক্ষে আজকের রাজনীতি। যে কারণে আগামী নির্বাচন হবে কী হবে না, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। মূল্যস্ফীতির চাপে তাদের দম বেরিয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, তাদের দুঃখ-দুর্দশায় ক্ষতাসীনরা নির্দয় আর বিরোধীরা নির্বিকার।
অর্থনীতির বেলায় মোটা দাগে যা বলা যায় তা হলো, বিশ্ব অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তো আছেই, তার সঙ্গে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দামও বেড়েছে। এ লাগামহীন চলা কবে নাগাদ বন্ধ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে সব দেশই কিছু কিছু সাবধানতার পথ অবলম্বন করছে। বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্বের বাইরে কেউ নয়, তাই অর্থনৈতিক চাপ থেকে আমরাও মুক্ত নই। সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নিয়মিতভাবেই অর্থ বিভাগের একটি মূল্যায়ন থাকে এবং তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি নিয়ে অর্থ বিভাগের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এর ধাক্কায় কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নেতিবাচক ধারা বইছে আমদানি খাতে। কমেছে সরকারি বাজেটের অর্থ ব্যয়। তবে এ সময়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে রাজস্ব ও প্রবাসী আয়। অর্থ বিভাগের মূল্যায়ন অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তবে কোভিড শুরুর আগে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল দেশের অর্থনীতিতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড সৃষ্টি হয় দেশের অর্থনীতিতে। তবে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটে করোনা মহামারির কারণে; নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হার কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। পরবর্তীকালে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে। কিন্তু চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, গম, ভোগ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় বিশ্ববাজারে পরিবহণ ব্যয়ও। বিশ্ব অর্থনীতির এ প্রভাব বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যয় হয়েছে ৭৫ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এটি মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে ব্যয় কম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি ব্যয় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। আমদানি খাতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি বা ২০ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। গত জুলাই-ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এরপরও শঙ্কা রয়েছে এ ধারা অব্যাহত থাকবে কি না।
আমরা বিশ্ব অর্থনীতির অংশ। সে হিসাবে বিশ্বের কোনো সংকটে আমরা অক্ষত থাকতে পারি না। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধি কম, তবে আমরা অবুঝ নই। আমরা এতটুকু বুঝি যে, আমাদের অর্থনীতির দুর্গতির সবটা বিশ্ব অর্থনীতির কারণে নয়। সরকারি নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতাও এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এ স্বল্প পরিসরে অন্তত দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই, যা আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল করে দিয়েছে, অথচ এর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথমটি হলো-খেলাপি ঋণ। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। সাবেক ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম ঋণখেলাপিদের নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় গবেষণা করেছেন। ঋণখেলাপিদের আজকের অবস্থা সম্পর্কে তার বক্তব্য হলো, দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই বর্তমান অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের অস্বাভাবিক রকম ছাড় দিতে শুরু করেছিলেন। চার বছর ধরে তিনি তার এ ঋণখেলাপিপ্রীতি অব্যাহত রেখেছেন আরও অনেক পরিবর্তনের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাসিফায়েড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে মাত্র ৯৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায় ক্লাসিফায়েড লোন। বলা হয়, নতুন পদক্ষেপগুলোর কারণে খেলাপি ঋণ কমে গেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্র্রা তহবিল (আইএমএফ) এ দাবির প্রতিবাদে ব্যাখ্যাসহ জানায়, ওই পর্যায়ে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফের উল্লিখিত পরিমাণে যেহেতু রাইট অফ করা বা মন্দ ঋণ (কিংবা অবলোপিত ঋণ) অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই প্রকৃত খেলাপি ঋণ তখনই ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা। এরপর যখন ২০২০ সালে করোনা মহামারি আঘাত হানল, তখন আর কোনো ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি ঘোষণা না করার নীতি গ্রহণ করে সরকার। আড়াই বছর পর গত সেপ্টেম্বরের শেষের হিসাব প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ওই সময় ক্লাসিফায়েড লোন ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমার ধারণা, এখন দেশে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ হয়তো ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী তার চার বছরের মেয়াদে সফলভাবে তার ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ বন্ধুদের খেলাপি ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোয় হুহু করে তা বেড়ে চলেছে। এটাই হলো দুঃখজনক। এ দুঃখ প্রকাশ করাটাই আমাদের মতো আমজনতার শেষ সক্ষমতা।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো অর্থ পাচার, যার সঙ্গে বৈশ্বিক অবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং দেশের অভ্যন্তরের কিছু মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের বোর্ড সভায় বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাবটি পাশ হয়েছে। পরিমাণটা কত? মাত্র ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। কত দিনে আমরা তা পাব? ৬ কিস্তিতে ৩ বছরে। এ ঋণ পাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে জ্বালানি তেল, পরে বিদ্যুৎ, তারপর গ্যাস, আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হলো। অথচ গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর যদি কোনো প্রতিকার না হয়, তাহলে ৩ বছরে আমরা ঋণ পাব ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আর একই সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাবে ২৪ বিলিয়ন ডলার।
সুতরাং, সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সংকটের যে বৈশ্বিক কারণকে ফলাও করে প্রচার করা হয়ে থাকে, তা আদৌ যথাযথ নয় এবং তা আংশিক। আসল সংকট সরকার পরিচালন ব্যবস্থাপনায়। অনিয়ম ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অর্থনীতিতে যে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, তা থেকে শিগগিরই নিষ্কৃতি পাওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়