গৌতম আদানিকে ঘিরে বিতর্কের জেরে আজ সোমবারও অচল হয়ে গেল ভারতের পার্লামেন্টের দুই কক্ষের অধিবেশন। এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অস্বাভাবিক নীরবতার প্রতিবাদে বিরোধীরা দুই সভাই অচল করে দেন। আগামীকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে অংশ নিতে বিরোধীরা রাজি হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আদানি প্রসঙ্গে ওঠা যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। অগ্রাধিকার এটাই।
বিরোধীরা দাবি করলেও মঙ্গলবার লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করবেন কি না, তার কোনো ইঙ্গিত সরকার দেয়নি। বিরোধীদের দাবি মেনে গত আট বছরে একবারের জন্যও প্রধানমন্ত্রী কোনো বিষয়ে সংসদে মুখ খোলেননি। কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। সোমবার লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় বিরোধীদের জানিয়ে দেন, তাঁরা যে বিষয়ে দাবি জানাচ্ছেন, তার সঙ্গে সংসদের কোনো সম্পর্ক নেই। জনস্বার্থের বিষয় নয়। বিরোধীদের উদ্দেশে ধনখড় বলেন, ‘আপনারা মানুষের মন বোঝার চেষ্টা করুন। মানুষের কথা বলুন। জনস্বার্থবিষয়ক প্রশ্নের অবতারণা করুন।’ লোকসভায় ওম বিড়লাও বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের এই স্লোগানবাজির সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো যোগাযোগ নেই।’
গত সপ্তাহের মতো সোমবার সকালেও সংসদের অধিবেশন শুরুর আগে রাজ্যসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেস সদস্য মল্লিকার্জুন খাড়গের ডাকে ১৬টি বিরোধী দলের সদস্যরা যোগ দেন। সেখানে সভাকক্ষে বিরোধীদের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে কথা হয়। ঠিক হয়, সরকার নীরব থাকলে অধিবেশন চলতে দেওয়া হবে না। যদিও সোমবার থেকেই রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপক প্রস্তাব আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিরোধীরা তা করতে দেননি। সরকারের বিবৃতির দাবিতে তাঁরা সরব থাকেন।
সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। ফলে প্রথমে বেলা দুইটা, তারপর সারা দিনের মতো দুই কক্ষের অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। বিরোধীরা সংসদ ভবন চত্বরে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির সামনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। খাড়গের ডাকা বৈঠকে যোগ না দিলেও ওই সমাবেশে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মহুয়া মৈত্র উপস্থিত ছিলেন।
বিরোধীদের দাবি, আদানির বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগের তদন্ত করতে হয় যুগ্ম সংসদীয় কমিটি গঠিত হোক নতুবা সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটি তদন্ত করুক। সংসদে নীরব থাকলেও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বলছেন, ভারতীয় শেয়ারবাজার সুনিয়ন্ত্রিত। রেগুলেটর হিসেবে ‘সেবি’ তার দায়িত্ব পালন করছে। তারা স্বশাসিত সংস্থা। সরকারনিয়ন্ত্রিত নয়। এলআইসি ও স্টেট ব্যাংকের লগ্নি সামান্যই। সাধারণের স্বার্থ সুরক্ষিত। ভারতের অর্থনীতির ভিত ও কাঠামোও অত্যন্ত পোক্ত। সংসদ চলাকালে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংসদেই বলা রীতি। বিশেষ করে কোনো দাবিতে বিরোধীরা যখন সরব হন।
আদানির বিভিন্ন শিল্পে ভারতের জীবনবিমা করপোরেশন (এলআইসি) ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বিপুল লগ্নির বিরুদ্ধে কংগ্রেস সোমবার দেশজুড়ে ওই দুই সংস্থার বিভিন্ন অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। তাদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে তাঁর ঘনিষ্ঠ উদ্যোগপতি আদানির বিভিন্ন প্রকল্পে এই দুই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আগুপিছু বিবেচনা না করে বিপুল লগ্নি করেছে। জনগণের টাকা নয়ছয় করেছে।
সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের হিনডেনবার্গ রিসার্চ এক গবেষণাপত্রে আদানি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারচুপি করে ধনী হওয়ার অভিযোগ আনে। ওই প্রতিবেদনের ফলে আদানির সব প্রকল্পের শেয়ারের মূল্য মারাত্মকভাবে পড়ে যায়। অবস্থা এতই সঙিন হয়ে যায় যে আদানি এন্টারপ্রাইজের আনা নতুন শেয়ার বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরও তা বাতিল ঘোষণা করতে হয়। শেয়ারবাজারের লোকসানের ফলে গৌতম আদানি বিশ্বের তৃতীয় ধনী থেকে নেমে যান ২২ নম্বরে।
সোমবারও আদানি সাম্রাজ্যের শেয়ারের দরপতন সেভাবে বন্ধ হয়নি। আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোনের শেয়ার ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ ও আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ ও এনডিটিভির শেয়ার ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি ছাড়া অন্য সব শেয়ারের দরপতন ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে আদানি ট্রান্সমিশনের, ১০ শতাংশ। আদানি টোটাল গ্যাস, আদানি গ্রিন এনার্জি, আদানি পাওয়ার ও আদানি উইলমারের দরপতন হয়েছে ৫ শতাংশ করে। অম্বুজা সিমেন্টের দাম পড়েছে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ ও এসিসির ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। বিতর্ক দানা বাঁধার পর থেকে গত ১০ দিনে আদানি গোষ্ঠীর মোট লোকসানের পরিমাণ ১১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় পৌনে ১০ লাখ কোটি রুপি।