শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
মুসলিম বিশ্বাসের প্রধান তিন মৌল বিষয় হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। আখিরাত অর্থ পরকালে বিশ্বাস। সব সৃষ্টি ফানা বা লয়প্রাপ্ত হবে; অতঃপর ফলাফল প্রদানের উদ্দেশ্যে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। কোরআনের ভাষায় ‘যা আছে এর মাঝে তার সবই ফানা বা লয় হবে; থাকবে শুধু তোমার রবের সত্তা।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ২৬-২৭)
যাঁরা কিয়ামত ও পরকালে অবিশ্বাস করেন, তাঁদের নিমিত্তে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘তারা কী বিষয়ে প্রশ্ন করে? মহাপ্রলয়ের বিষয়ে! যে বিষয়ে তারা মতভেদে লিপ্ত। না, অচিরেই তারা জানতে পারবে; অতঃপর শিগগিরই তারা নিশ্চিত হতে পারবে।’ (সুরা-৭৮ নাবা, আয়াত: ১-৫) ‘যখন কিয়ামতের ঘটনা সংঘটিত হবে, তখন উহা অস্বীকার করার কেউ থাকবে না। ইহা কাউকে করবে অপমানিত আর কাউকে করবে সম্মানিত।
কিয়ামতের দিন ইমানদারদের চেহারা হবে উজ্জ্বল আর পাপীদের চেহারা হবে কুৎসিত কদাকার কালো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ওই দিন কিছু লোকের চেহারা উজ্জ্বল হবে, আর কিছু লোকের চেহারা হবে মলিন কালো।’
যখন পৃথিবী প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে। আর তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন দলে; অতঃপর ডান দিকের দল; ডান দিকের দলটি কত সৌভাগ্যবান! বাম দিকের দল; আর বাম দিকের দলটি কত হতভাগা! আর অগ্রবর্তী দল—তারা নৈকট্যপ্রাপ্ত।’ (সুরা-৫৬ ওয়াকিআহ, আয়াত: ১-১১)
কিয়ামত মানে দাঁড়ানো, এই দিন যেহেতু বিচারের পূর্ব পর্যন্ত সবাইকে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে, তাই এই দিনের নাম কিয়ামত। এই দিন হবে অত্যন্ত দীর্ঘ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেই দিনের পরিমাণ তোমাদের গণনায় সহস্র বৎসর।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ৫) কোরআন মাজিদে আরও রয়েছে, ‘ওই দিনের ব্যাপ্তি পঞ্চাশ হাজার বছর।’ (সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ৪) সেদিন সূর্য মাথার এক বিঘত ওপরে থাকবে, পায়ের নিচে জমিন হবে তামার।
পাপী–তাপী–গুনাহগারেরা ঘামতে থাকবে। পাপের পরিমাণ হিসাবে কষ্টের ও ঘামের পরিমাণ হবে। কারও হাঁটু পর্যন্ত, কারও কোমর পর্যন্ত, কারও বুক পর্যন্ত, কারও গলা পর্যন্ত এবং কারও ঘামে সাঁতার হবে; তারা তাতে হাবুডুবু খাবে।
কিয়ামতের দিনে হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া ব্যতীত কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না। সেদিন নেককার ইমানদারেরা আরশের সুশীতল ছায়ায় স্থান পাবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না।
(তাঁরা হলেন) ন্যায়পরায়ণ শাসক, সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে (মসজিদের প্রতি তাঁর মন সদা আকৃষ্ট থাকে), সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভালোবাসে এবং তারা এই ভালোবাসার ওপর মিলিত হয় ও এই ভালোবাসার ওপরেই বিচ্ছিন্ন হয় (মৃত্যুবরণ করে); সেই ব্যক্তি যাকে কোনো কুলকামিনী সুন্দরী রমণী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে; কিন্তু সে বলে, “আমি আল্লাহকে ভয় করি”, সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপনে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাতও জানতে পারে না, আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে অশ্রুধারা বয়ে যায়।’ (বুখারি: ৬৬০, মুসলিম: ১০৩১, তিরমিজি: ২৩৯১, নাসায়ী: ৫৩৮০, মুসনাদে আহমাদ: ৯৩৭৩, মুওয়াত্তা মালিক: ১৭৭৭, ইবনু হিব্বান: ৪৪৮৬)
কিয়ামতের দিন ইমানদারদের চেহারা হবে উজ্জ্বল আর পাপীদের চেহারা হবে কুৎসিত কদাকার কালো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ওই দিন কিছু লোকের চেহারা উজ্জ্বল হবে, আর কিছু লোকের চেহারা হবে মলিন কালো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১০৬) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘অপরাধীরা সেদিন নিজ নিজ চেহারা দ্বারাই চিহ্নিত হয়ে যাবে এবং তাদের কপালের চুল ও পা ধরে চ্যাংদোলা করে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হবে।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ৩৯-৪১)
কিয়ামতের মাঠে সব প্রাণীর দুনিয়ার জুলুমের প্রতিশোধ প্রতিবিধান করা হবে। জীবজন্তুদের বিচারের পর বলা হবে ‘তোমরা মাটি হয়ে যাও’। তখন তারা সবাই মাটিতে মিশে যাবে। মানুষ এ দৃশ্য দেখবে। পাপী মানুষেরা যখন সামনে কঠিন বিপদ-মসিবত দেখবে, তখন বলবে—‘হায়! আমিও যদি মাটি হয়ে যেতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো!’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন; সুরা-৭৮ নাবা, আয়াত: ৪০)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com