অসীম সাহা
ভাষা শুধু কথা বলা বা লেখাপড়ার মাধ্যম নয়, অনুভূতি প্রকাশের এবং চেতনার বিপ্লব সম্পন্ন করারও মাধ্যম। তার প্রমাণ ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। যারা এ আন্দোলনকে শুধু রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান, তারা তার অন্তর্গত ব্যঞ্জনা বুঝতে অক্ষম।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান ও খন্ডিত ভারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভক্তি, পাকিস্তান ভূখন্ডে সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠী উর্দুভাষী পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। এতে বাঙালির চেতনায় যে আঘাত লাগে, তারই ফলে নিজেদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণœ রাখতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি তরুণ সমাজ ব্যাপক আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। বুঝিয়ে দেয় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি কখনো মাথা নত করবে না। তাই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া বর্বর সেনাবাহিনী সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার প্রমুখের বুকের তাজা রক্ত কেড়ে নিয়ে নতুন করে বাঙালিদের বুঝতে বাধ্য করে, অখন্ড পাকিস্তানের ধারণাটি ছিল সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব। তখন থেকেই বাঙালি জাতির চেতনার জাগরণে ক্রমাগত বাঁকবদল হতে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভারত-বিভক্তির পরপরই বুঝে ফেলেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে একত্রে থাকা আর সম্ভব নয়। সেই থেকে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। তারই অনিবার্য অভিঘাতে অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালির চেতনার নিভৃতে যে নীরব ও সরব জাগরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সেই ভাষা কি ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহীদদের স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারছে? বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায় পর্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার যে নির্লজ্জ ও মূর্খ প্রয়াস অব্যাহত আছে এবং আমাদের অধিকাংশ সংবাদপত্র, টিভি ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম ভাষা-প্রয়োগে যে অনাচার চালিয়ে যাচ্ছে, তা ভাষাশহীদদের প্রতি শুধু অবমাননা নয়, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতিও অশ্রদ্ধার শামিল। শুধু ফেব্রুয়ারি এলে মাতৃভাষার প্রতি কৃত্রিম দরদ দেখানোর যে নাটক ক্রমাগত জাতীয় জীবনে মঞ্চস্থ করার প্রতিযোগিতা চলে, তার রেশ টানার ক্ষেত্রে শুধু প্রথাগত নির্দেশনা কোনো কাজেই লাগবে না, যদি না চেতনার বিপ্লব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের জাতির বিবেক লেখক-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিজীবী-সাংবাদিক-শিক্ষক প্রমুখ এগিয়ে না আসেন। আমাদের কষ্ট হয়, যখন দেখি রাস্তাঘাটে, অফিসে-আদালতে, সরকারি উদ্যোগ-আয়োজনে বাংলার বদলে ইংরেজি প্রাধান্য পায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি নামগুলো বাংলায় লিখে বাংলার প্রতি দরদের নামে তার অপমানই করা হয়! বিস্ময়কর হলো, এগুলো দেখার কিংবা এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগও অপ্রতুল! এতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর মাধ্যমে শুধু ভাষার প্রতি নয়, জাতির পিতার স্বপ্নের প্রতিও তারা অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে। এটা জাতির জন্য লজ্জার। এ ধরনের অবহেলা বা অবজ্ঞা যে ভাষার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, জ্ঞানপাপীরা তা বুঝেও বোঝে না। এখন যেভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার চলছে, তাতে প্রাধান্য পাচ্ছে স্বেচ্ছাচার। এ স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষার অবলুপ্তির জন্য সতর্ক সংকেত দিচ্ছে! জাতি হিসেবে আমরা কি এই ভয়ানক সংকেত মেনে নিতে পারি? কিছুতেই না। এখনো সময় আছে, চূড়ান্ত সর্বনাশের আগেই যেন আমরা সম্মিলিতভাবে বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য নতুন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, তারা জন্য ‘ভাষাযুদ্ধ’-এর প্রস্তুতি নিতে তরুণ সমাজকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। ভাষার মাসে ‘ভাষাযুদ্ধ’ হোক আমাদের চূড়ান্ত অঙ্গীকার। লেখক : কবি ও সাংবাদিক