তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে। মাঝে পার হয়ে গেছে এক সপ্তাহ। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষকে উদ্ধারের আশা শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু এই হতাশার মাঝেও পাওয়া যাচ্ছে একাধিক ‘অলৌকিক ঘটনার’ গল্প। তাদেরই একজন হচ্ছেন নেকলা কামুজ।
গত ২৭শে জানুয়ারি নিজের দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম দেন কামুজ। তার নাম রাখেন ইয়াগিজ, যার অর্থ ‘সাহসী একজন’। এর ঠিক ১০ দিনের মাথায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধসে পড়ে তাদের বাড়ি। আর কামুজসহ তার গোটা পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। নেকলা কামুজ ও তার পরিবার সমন্দগ শহরে একটি আধুনিক পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। তিনি বলেন, এই ভবনটি খুবই সুন্দর ছিল।
এখানে আমি সবসময় নিরাপদ বোধ করতাম।
তবে তিনি জানতেন না, ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে গোটা এলাকাটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। প্রতিটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে। কামুজ বলেন, যখন ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। তিনি এ সময় অন্য ঘরে ছিলেন। আমার স্বামীও ছুটে আমার কাছে আসতে চান। তার সঙ্গে আমার আরেক ছেলে ছিল। কিন্তু তারা যখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করছিল, তখন তাদের ওপর ভারী একটি ওয়ারড্রপ পড়ে যায়। ফলে তাদের পক্ষে নড়াচড়া করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ে। এ সময় ঘরটি কাঁপছিল এবং গোটা ভবনটিই অবস্থান পরিবর্তন করছিল। ভূমিকম্প যখন থামে তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে এরইমধ্যে আমি এক তলা নিচে পড়ে গিয়েছি। আমি আমার স্বামীকে ডাকলাম কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।
৩৩ বছর বয়সী কামুজের কাছে এ সময় তার সদ্য জন্ম নেয়া শিশু ইয়াগিজ ছিল। এত ঘটনার মধ্যেও তিনি তার ছেলেকে ছাড়েননি। তাদের উপরে একটি কংক্রিটের বড় স্ল্যাব পড়েছিল কিন্তু একটি ওয়ারড্রপের কারণে সেটি তাদের পিষ্ট করতে পারেনি। এরপর প্রায় চারদিন ওই একই স্থানে আটকে ছিলেন তিনি ও তার ছেলে।
প্রথম দিন
ধ্বংসস্তূপের নিচে বসে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখছিলেন না কামুজ। আশেপাশে কী ঘটছে তা বুঝতে তাকে সবকিছু ধারণা করে নিতে হচ্ছিল। প্রথমেই তিনি নিশ্চিত হন যে ইয়াগিজ এখনো শ্বাস নিচ্ছে। ধুলোর কারণে প্রথমে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দ্রুতই ধুলোর সমস্যা দূর হয়। এসময় বাইরে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে থাকলেও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যথেষ্ট উষ্ণতা ছিল।
প্রথম দিনেই তিনি দূর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করেন এবং ওয়ারড্রোবে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। চিৎকার করে তিনি ডাকেন, ‘এখানে কি কেউ আছেন? কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন?’ যদিও কেউ তার সেই কথা শোনেনি। তিনি বলেন, আমি ভয় পাচ্ছিলাম। কেউ হয়তো আর কখনোই উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে না।
ভূগর্ভস্থ জীবন
ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্ধকারে কামুজ সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। তিনি বলেন, যখন নতুন সন্তান হয় তখন আপনি অনেক কিছুরই পরিকল্পনা করবেন। এরপর হঠাৎ আপনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যান। তবুও তিনি জানতেন যে, তাকে এখন ইয়াগিজের দেখাশোনা করতে হবে। চাপা পড়ে থেকেও তিনি তার ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কামুজ জানান, কোনোভাবেই পানি বা অন্য খাবারের কাছে যেতে পারেননি তিনি। ফলে একসময় নিজের বুকের দুধ খাওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে মাথার উপরে ড্রিলের গর্জন অনুভব করেন তিনি। মানুষের কথার শব্দও আসতে থাকে তার কাছে, যদিও তা বহুদূরে মনে হচ্ছিল। কামুজ সিদ্ধান্ত নেন তিনি তার শক্তি সঞ্চয় করবেন। মানুষেরা কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তিনি শব্দ করবেন না। তিনি নিজের জন্য ভাবছিলেন না। তার একমাত্র চিন্তা ছিল ইয়াগিজকে বাঁচিয়ে আনা।
উদ্ধার
ধ্বংসস্তূপের নিচে ৯০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চাপা পড়েছিলেন কামুজ। এরপর একসময় তিনি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পান। প্রথমে তিনি ভাবেন, কোনো স্বপ্ন দেখছেন হয়তো। তবে না, সত্যিই উদ্ধারকারীরা এসেছে এবার। তাকে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ঠিক আছেন? উদ্ধারকারীরা যতœ সহকারে তার আশেপাশের কংক্রিট ভাঙছিল যাতে তার ও তার সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়।
উদ্ধারের পর ইস্তাম্বুল মিউনিসিপ্যালিটির ফায়ার ডিপার্টমেন্টের উদ্ধারকারী দল যখন জিজ্ঞাসা করেছিল ইয়াগিজের বয়স কতো, কামুজ তা বলতে পারেননি। তিনি কেবল জানতেন যে, ভূমিকম্পের সময় তার বয়স ছিল ১০ দিন। ইয়াগিজকে উদ্ধারকারীদের কাছে হস্তান্তর করার পর নেকলাকে তখন একটি স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তার সামনে বিশাল জনতা দেখতে পান, তিনি যদিও তাদের কাউকেই চিনতেন না। এম্বুলেন্সে বসে কামুজ নিশ্চিত হন যে, তার সন্তানও সুস্থ আছে। হাসপাতালে পৌঁছার পর তিনি জানতে পারেন যে, তার স্বামী ও আরেক সন্তানকেও উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও তারা এই হাসপাতালে নেই। আদানা প্রদেশের একটি হাসপাতালে রয়েছেন তারা। উভয়ের পায়েই গুরুতর আঘাত লেগেছে।
কামুজ দ্রুত তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রেখেছিল চিকিৎসকরা। তিনি সুস্থ থাকলেও তার স্বামী ও আরেক ছেলে আহত হয়েছেন। কামুজের এখন থাকার জন্য কোনো বাড়ি নেই। তিনি এখন কাঠ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী নীল একটি তাঁবুতে থাকেন। একই তাঁবুতে তিনি ছাড়া আরও ১৩ জন থাকেন, সবাই-ই বাড়ি হারিয়েছে। সবাই নিজেরা নিজেদের সাহায্য করে তাঁবুতে।
কামুজ বিশ্বাস করেন, তার ছেলে ইয়াগিজই তার জীবন বাঁচিয়েছে। কারণ সে না থাকলে বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলতেন তিনি। তার জীবনের এখন একমাত্র আশা, ইয়াগিজকে যেন জীবনেও আর এরকম কিছুর মধ্যদিয়ে যেতে না হয়। কামুজ বলেন, আমি খুব খুশি যে, সে এখনো শিশু এবং এর কিছুই তার মনে থাকবে না।