সরকার আবদুল মান্নান
মানুষ কী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সৃষ্টিশীল প্রতিভা লাভ করে, তার কোনো ব্যাকরণ নেই। কিন্তু এই সৃষ্টিশীল জগতের অনেকেই বলেছেন, কোনো না কোনো প্রেরণা মানুষকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের শৈশবের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল ও বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেকের সৃষ্টিশীল প্রতিভার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে। এ রকম অসংখ্য ঘটনার ভেতর দিয়ে মানুষ সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। একুশের বইমেলা এই সৃষ্টিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি বলে আমাদের মনে হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সম্ভবত ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির বর্তমান হাউসের সামনের বটতলায় মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা প্রথম বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলার আয়োজক ছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে অন্য প্রকাশকরাও তার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
এরপর প্রতিবছরই এই মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্ধিত পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৪ সাল থেকে মহান একুশের চেতনাকে ধারণ করে একুশে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বর্ধমান হাউসকে ঘিরে বাংলা একাডেমি চত্বরে মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে মেলা সম্প্রসারিত হয়ে বাংলা একডেমির উল্টো দিকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
সেই থেকে আজ অবধি বইমেলাকে কেন্দ্র করে পাঠকদের তো বটেই, লেখকদেরও এক বিপুল সমাবেশ ঘটে। বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন শাখার লেখকরা একত্রিত হওয়ার একটি অসাধারণ প্ল্যাটফর্ম হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা হিসেবেও এই গ্রন্থমেলা ফল্গুধারার মতো নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন নয় যে একুশে গ্রন্থমালা ছাড়া কেউ প্রেরণা লাভ করেন না। বরং বলা যায়, গ্রন্থমেলা সামনে রেখে সারা বছর লেখকদের মধ্যে এক ধরনের বোধ কাজ করে, এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এই বোধ এবং আকাঙ্ক্ষা হলো মেলায় গ্রন্থ প্রকাশ করা। লেখকরা স্বীকার করুন অথবা না-ই করুন, এই বোধ মনে হয় সবার মধ্যেই কমবেশি থাকে।
হয়তো এমন হতে পারে, মেলাকেন্দ্রিক গ্রন্থের পরিকল্পনা সৃষ্টিশীল প্রতিভার জন্য মঙ্গলজনক নয়। আবার এই ধারণার সঙ্গে অনেক সময় একমতও হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, না খোঁচালে খেজুরগাছও রস দেয় না। তার মানে সৃষ্টিশীলতার পেছনে এক ধরনের তাড়া বা তাড়না থাকতে হয়। স্বতঃস্ফূর্ততার ভেতর থেকে সব সময় লেখার কাজ হয় না। প্রকাশকরা যদি তাড়া দেন, তা হলে বাধ্য হয়েই লিখতে হয়। এ ধরনের লেখার মান খারাপ হয়, এমন ধারণা সব সময় ঠিক নয়। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা আমাদের লেখকদের জন্য সে রকম একটি প্রেরণাস্থল।
সৃষ্টিশীল চিন্তার এক ধরনের আর্কেটাইপ থাকে। আর তা হলো, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছার তাড়না। আনন্দবাদী লেখকরা যা-ই বলুন না কেন, কোনো সৃষ্টিশীল মানুষই শুধু নিজের আনন্দের জন্য সৃষ্টিকর্ম রচনা করেন না। তাকে পৌঁছতে হয় পাঠকের কাছে। এই তাড়না তাকে উজ্জীবিত রাখে, বাঁচিয়ে রাখে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্যে নিমজ্জিত রাখে। বাংলা একাডেমির বইমেলা লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার একটি চমৎকার আয়োজন। লেখক, পাঠক, সংস্কৃতিকর্মী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লোকজনÑসবাই এই আয়োজনে সমবেত হওয়ার সুযোগ পান। সুতরাং পাঠকের কাছে পৌঁছার এই যে বিপুল আয়োজন, তা থেকে কোনো লেখকই নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। ফলে অনিবার্যভাবেই মেলাকেন্দ্রিক গ্রন্থ প্রকাশের তাড়না কমবেশি সব লেখকের মধ্যেই থাকে।
সৃষ্টি নিঃসন্দেহে নিঃসঙ্গ। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যখন তার সৃষ্টিকর্মে মনোনিবেশ করেন, তখন তার মতো নিঃসঙ্গ মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়জনকে পাওয়া যাবে না। এ হলো সৃষ্টি-মুহূর্তের নিয়তি। কিন্তু এই সৃষ্টি-মুহূর্ত বিনির্মাণের কিছু পটভূমি থাকে। আর সেই পটভূমি হলো জীবন ও জগতের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া। বইমেলাকেন্দ্রিক যে মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়, বিচিত্র যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন লেখকরা, সেখানে ফল্গুধারার মতো সৃষ্টিপ্রবাহ বইতে থাকে। হয়তো অনেক লেখক নিজেও অনুধাবন করতে পারেন না যে মেলাকেন্দ্রিক প্রেরণার ভেতর থেকে তিনি কী করে নতুন একটি সৃষ্টির মুখোমুখি হলেন। কিন্তু অনেক লেখককেই বলতে শুনেছি, একুশের বইমেলা তাকে লেখক হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার এক বার্ষিক কর্মসূচি।
একুশের বইমেলায় প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। বইমেলাকে আশ্রয় করে অনেক নতুন লেখক আবির্ভূত হন। সেই সব গ্রন্থ সাহিত্য হিসেবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা সাহিত্যপদবাচ্য, তা অন্য এক আলোচনার বিষয়। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে তাদের সেই সৃষ্টিকর্ম সবটুকুই বৃথা নয়। সেখান থেকেই ক্রমে বেরিয়ে আসেন শক্তিমান কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, গবেষক ও অনুবাদ সাহিত্যিক। গবেষণা থাকলে স্পষ্টতই দেখা যেত যে স্বাধীনতা-পূর্বকালে যে পরিমাণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আনুপাতিক হারে গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই লক্ষণ কোনো অবস্থাতেই অশুভ নয়, অকল্যাণকর নয়। বরং মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর। সৃষ্টির ভেতর দিয়ে শুভবুদ্ধির বিকাশ সাধিত হয়। যখন কেউ কবিতা লেখেন, সেই কবিতা মানের দিক থেকে যা-ই হোক না কেন, কবি একটি শুদ্ধতম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ওই সময়টুকু অতিবাহিত করেন। কারণ তিনি শব্দ নামক ব্রহ্মকে আরাধনা করেন। এই বোধ মহার্ঘ্য। একে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
সব শাখার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা একই নয়। তাদের মধ্যে নতুন বোধ ও ভাবনার জন্ম নেয়। এমনকি যারা সাহিত্যচর্চা করেন না, যারা সংস্কৃতিকর্মী কিংবা সাধারণ পাঠক, তাদের মধ্যেও মেলাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের নতুন বোধ জন্ম নেয়। এই বোধ সৃষ্টিশীলতারই আরেক অধ্যায়। সুতরাং বলা যায়, অমর একুশে বইমেলা আমাদের জীবনে সৃষ্টিশীল সংস্কৃতির বাতাবরণ। আজকে যখন দেখি, সারা দেশের স্কুল-কলেজে, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আঙিনায় বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে, তখন ভাবতেই ভালো লাগে যে আমাদের সৃষ্টিশীলতার আবহাওয়া দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ আছে। অমর একুশে বইমেলা আমাদের এই আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করে, বাঁচিয়ে রাখে।
লেখক: প্রাবন্ধিত ও গবেষক