নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দাম কমেছে চাল ও আটার। তবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে। তবে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে দেশের অর্ধেকের (৫৩ শতাংশ) বেশি মানুষ। তাই এখন জীবনযাপনের খরচ মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। খাদ্যের দাম বাড়ায় তারা তাদের জীবনযাত্রার অন্য খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের নিম্নআয়ের মানুষের আয়-ব্যয়ের জরিপে এ তথ্য মিলেছে।
এদিকে সাধারণ মানুষের প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা ও বড় উৎস ব্রয়লার মুরগির দাম চড়তে চড়তে ২৩০ টাকা ছুয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডিমের দাম; রাজধানীর বাজারগুলোতে এক হালি ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা। এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশ, ডিমের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ। বিক্রেতারা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এত দামে তারা ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেননি। দাম বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ তার খাবার মেন্যু থেকে সস্তা প্রোটিনের উৎসটিতেও কাটছাঁট করছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে এদেশে প্রতিদিন ৪ থেকে সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়। কেন দাম বাড়ছে : ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনকারী খামারিরা বলছেন, বর্তমানে মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৮ টাকা সর্বোচ্চ। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ১১.১১ টাকায়। ফলে বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। আমদানি কম, মুরগির বাচ্চার দাম বাড়তি। সেই সঙ্গে খাদ্য, তেল ও গাড়িভাড়া সবকিছুর দামই বেশি।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির প্রতিদিনের বাজার দরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার ঢাকার ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ২১০ থেকে ২২০ টাকা, এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৮০-২০০ টাকা। আর এক মাস আগে ছিল ১৪০-১৫০ টাকা। এই হিসাবে এক মাসে দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশের বেশি।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে। আর গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে, অর্থাৎ এক মাসে বেড়েছে ৪ শতাংশ। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনা বাবদ মাসে মাথাপিছু খরচ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩৯ টাকা, যা উপার্জন করা গরিবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর কোভিড সংক্রমণের আগের সময় অর্থাৎ ২০২০-এর মার্চের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে ৫৩ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে জীবনযাপন ও খাদ্য বাবদ খরচ কমিয়েছে, তারা টিকে থাকতে তিনটি উপায় বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে। ৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় বা জমানো টাকা ভেঙে প্রতিদিনের খরচের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করছে বা অন্যত্র চলে গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে।
খাদ্য নিয়ে চাপে থাকা পরিবারগুলো যতটুকু বাজারসদাই করতে পারছে, তা প্রথমে ঘরের শিশুকে খাওয়াচ্ছে। পরিবারের অন্যরা কম খাবার খাচ্ছে। বিশেষ করে মাছ, মুরগি, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো খাবার খাওয়া তারা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে তাদের পুষ্টির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত ও অন্যান্য বিনোদন বাবদ খরচ কমিয়ে দেওয়ায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষের আমিষের প্রধান উৎস ছিল ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও ডাল। আর ভোজ্যতেল হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের অন্যতম উৎস। গত এক বছরে ওই সব কটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো ন্যূনতম আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত আছে। রমজান মাসে আমরা এক কোটির বেশি পরিবারকে মাসে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেব। আগামী মাস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু করা হবে। এ ছাড়া ওএমএসের আওতা এবং ট্রাকপ্রতি খাদ্যের পরিমাণও বাড়ানো হবে। ফলে আশা করি, খাদ্য নিয়ে যে সমস্যা চলছে তা আর থাকবে না।