ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ও এম এ খালেক চক্র ১০ বছরে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। চক্রটি চার বছরে ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে প্রতিষ্ঠানটির জমি কেনার ক্ষেত্রে দাম নিয়ে কারসাজি করে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সাতটি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ফারইস্ট লাইফের ওপর করা একটি অডিট হাউজের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অডিটে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন দুটি আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তদন্ত করছে। তদন্তে নেমে সংস্থাগুলো খালেক ও নজরুল ইসলাম চক্রের আরও অন্তত এক ডজন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে।
অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স থেকে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জমি কেনার ক্ষেত্রে দাম নিয়ে কারসাজি, নিজেদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও প্রতারণামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠানে অগ্রিম অর্থ দেওয়াসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে প্রায় ৪৩২ কোটি টাকার। নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং কোম্পানির কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত। এছাড়া নজরুল ইসলাম এবং এম এ খালেকের পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠজনরা অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত রয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক লেনদেন এবং সম্পদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
এছাড়া মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে প্রতিষ্ঠানটির ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে চক্রটি। এর মধ্যে প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স ও ম্যাকসন্স মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। অডিটে বলা হয়েছে, ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি এবং কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ এফডিআর ছিল ১ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যেটি পরবর্তী বছর হতে কমতে শুরু করে ২০২০ সালে দাঁড়ায় ৪০৫ কোটি টাকা।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের জন্য জমি কেনায় কারসাজি করে টাকা লোপাটের ব্যাপারে তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, নজরুল ইসলাম-এম এ খালেক চক্রটি ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে প্রতিষ্ঠানটির জমি কেনার ক্ষেত্রে দাম নিয়ে কারসাজি করেই প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা জানিয়েছেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের পূর্ব পাশে ৩৬, তোপখানা রোডে ৩৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ জমির ওপরে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব আরেকটি পুরোনো ভবন রয়েছে। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে পুরোনো ভবনসহ জায়গাটি প্রায় ২০৭ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকায় আজাহার খান ও সোহেল খান ভাইদ্বয়ের নিকট হতে ক্রয় করা হয়। এই আজহার খান (মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির মালিক) ও সোহেল খান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লি. এর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফারইস্ট এই জমি ক্রয় বাবদ সমস্ত মূল্য আজাহার খানের মালিকানাধীন মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে (হিসাব নং-০০২১০১০০০০০৪৭, ইউনিয়ন ব্যাংক লিঃ, গুলশান-১, ঢাকা) প্রদান করে। আজাহার খান প্রথমে জমিটি ক্রয়ের জন্য ২০১৩ সালে শেষের দিকে জনৈক মজিবুর রহমান গংদের নিকট ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বায়না করেন এবং সম্পূর্ণ অর্থই নজরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আজহার খান ইউনিয়ন ব্যাংক হতে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেন। আজাহার খান জমিটি বায়না করেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নিকট বিক্রি করেন এবং ফারইস্ট থেকে জমির মূল্য পাওয়ার পরে জমির মূল মালিকদের বাকি পাওনা পরিশোধ করেন।
এদিকে অবৈধ লভ্যাংশ বাবদ আজাহার খান মিথিলা টেক্সটাইলের ইউনিয়ন ব্যাংক এর মাধ্যমে নজরুল ইসলামকে ৩ কোটি ২০ লাখ (পে-অর্ডার নং ০০২৫১০৬, তাং-২৪/৩/১৫), নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা ইসলামকে ৬ কোটি ৩০ লাখ (পে-অর্ডার নং ০০২৫১০৭, তাং-২৪/৩/১৫), এম এ খালেককে ৫ কোটি (পে-অর্ডার নং ০০২৫১০২, ০০২৫১০৩, তাং-২৪/০৩/১৫), এম এ খালেকের স্ত্রী সবিহা খালেককে ২ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার (পে-অর্ডার নং ০০২৫১০৪, তাং-২৪/০৩/১৫), এম এ খালেকের কন্যা সারওয়াত খালেদ সিমিনকে ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা (পে-অর্ডার নং ০০২৫১০৫, তাং-২৪/০৩/১৫) ও জনৈক কামাল উদ্দিনকে (নজরুল ইসলামের বেনামি) ১ কোটি ১০ লাখ টাকা (চেক নং ০০২১০১০০১৬৮৯) প্রদান করেন। এই কামাল উদ্দিনকে নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম কয়েক ধাপে ৪০ কোটি টাকা প্রদান করেন।
তদন্ত সূত্র বলছে, আজহার খান মূলত এই জমি ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্রিক আর্থিক দুর্নীতি করার জন্যই ২০১৩ সালের শেষের দিকে তার মালিকানাধীন মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে ব্যাংক হিসাবটি খোলেন। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের পরে হিসাবটিতে আর কোনো লেনদেন সংঘটিত হয়নি।
এদিকে ২০১৩ সালে মিরপুরের গোড়ান চটবাড়িতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও প্রাইম ইসলামী লাইফ অ্যামপ্লয়িজ সোসাইটির নামে ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৭৫০ টাকায় কেনা হয় ৭৩৯ শতাংশ জমি। অথচ জমি ক্রয়ে মোট খরচ দেখানো হয় ২২৯ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অর্থ আত্মসাতের জন্য ঐ জমি রেজিস্ট্রেশন বাবদ খরচ ৭১ কোটি ৯৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫০ টাকা দেখানো হয়েছে, রেজিস্ট্রেশন বাবদ খরচ বেশি দেখানো হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। জমিতে বালু ফেলার খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি টাকা, সরেজমিনে জমিতে খুব সামান্য পরিমাণ বালু ফেলার চিত্র পাওয়া যায়। এই জমি কেনা বাবদ ফারইস্টের নথি জালিয়াতি করে তহবিল থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আর আত্মসাৎ করতে জমি কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেওয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এই জমিটি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ এমপ্লোয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে কেনা হলেও ব্যয় করা হয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে। যা বিমা আইন ২০১০ অনুযায়ী অবৈধ।
অন্যদিকে ৭২ কাকরাইল ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির একটি জমি কেনা নিয়ে চরম দুর্নীতি ঘটেছে। জমিটি ১৬০ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তার স্বামী নজরুল ইসলামকে।
এছাড়া গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় আত্মসাৎ করা হয়েছে ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও দুই জমিতে প্রায় ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় এক জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রমাণ পেয়েছেন।
এছাড়া ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একটি জমি উন্নয়ন বাবদ নজরুল ইসলাম কোম্পানির ৭ কোটি টাকা অনামিকা এক্সপোর্টার্স কোম্পানিকে প্রদান করেন। কিন্তু কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় মো. নজরুল ইসলাম টাকা ফেরত নিয়ে ফারইস্ট কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা না করে বেনামি কামাল উদ্দিন এবং পঙ্কজ কান্তি দে নামে দুটি অ্যাকাউন্টে জমা করেন। এই দুই অ্যাকাউন্ট নজরুল ইসলামের বেনামি অ্যাকাউন্ট। পরবর্তী সময় ঐ বেনামি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। এর বাইরে ফারইস্ট ইসলামী প্রপার্টিজ লিমিটেডের ১০০ কোটি টাকার এমটিডিআর শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে লিয়েন রেখে ৯০ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করে চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম অন্যত্র স্থানান্তর করেছেন বলেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রমাণ পেয়েছেন।
এসব অবৈধ টাকায় নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ মার্কিন ডলার দিয়ে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছেন। বাড়িটির ঠিকানা ১১৫২২ মানাতি বে এলএন, ওয়েলিংটন, এফএল ৩৩৪৪৯। ঐ বাড়ি কিনতে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি, অর্থাৎ পুরো অর্থই একবারে পরিশোধ করা হয়। এছাড়া নজরুল ইসলাম নিজের নামে এবং তার স্ত্রীর নামে ঢাকার গুলশান বারিধারা নিকুঞ্জে ১৬টি ফ্ল্যাট এবং প্লটের মালিক হয়েছেন। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে দুটি বাড়ি এবং পটুয়াখালীতে একটি বাড়ি কিনেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি ক্রয়ের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ও এম এ খালেক এবং তাদের সহযোগী সিইও হেমায়েত উল্লাহ কোম্পানির নগদ লেনদেন, বোর্ডসভার কার্যবিবরণী জালিয়াতি, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের আগেই জমি ক্রয় ও আর্থিক প্রতিবেদনে গোঁজামিল হিসাব দিয়ে অনিয়ম দুর্নীতি ও জালিয়াতি করেন।