সংসদ নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের মূল প্রার্থীর সামনে দুই ঝুঁকির শঙ্কা

সংসদ নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের মূল প্রার্থীর সামনে দুই ঝুঁকির শঙ্কা

শামছুদ্দীন আহমেদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যারা আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের মধ্যে দুটি বিষয়ে শঙ্কা ভর করেছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিলে এবং সংবিধানে বেধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন হলে- সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের রসায়ন কী হয়; তা ভাবাতে শুরু করেছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের। বিএনপিহীন সম্ভাব্য ওই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির ‘যুদ্ধাংদেহী’ প্রতিযোগিতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘাতে রূপ নিতে পারে। আবার নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে দলীয়ভাবে ডামি প্রার্থী রাখার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে আসছে- তা সত্য হলে সেটি শুধু বিশৃঙ্খলাই নয়, বিপদও ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত ইমেজ এবং নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে- আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এমন কয়েকজন প্রার্থী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজেদের এই শঙ্কার কথা জানান। তারা বলছেন, বিশেষ করে বিগত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮ সালের) জাতীয় নির্বাচন এবং এই সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে মোটা দাগে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে নেতা-কর্মীদের কাছে। তা হলো- দলীয় মনোনয়ন বা সমর্থন পাওয়া মানেই নির্বাচিত হয়ে যাওয়া। যেমন সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের মনোনয়ন পেলেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। এমন ধারণা কিংবা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রায় প্রতিটি আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের পূর্ণ মনোযোগ ও সব ধরনের প্রচেষ্টা থাকে শুধু দলীয় টিকিট প্রাপ্তির দিকে। এলাকার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন, ভোটারদের মন জয় করা কিংবা নিজের পরিচ্ছন্ন ইমেজ গড়ে তোলার দিকে বেশিরভাগেরই মনোযোগ নেই। ‘দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তিতেই বিজয় প্রায় নিশ্চিত’- এমন ধারণা থেকে এখন বেশিরভাগ আসনেই দলের উল্লেখযোগ্য নেতাদের প্রায় সবাই এমপি হতে চান।

সবার এই ‘এমপি হতে চাওয়া’-কে বিপজ্জনক মনে করছেন অনেকেই। জানা গেছে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি রয়েছেন- এমন বেশিরভাগ আসনেই গড়ে ৫-৭ জন করে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের মনানয়ন পেতে এখন থেকেই মাঠে তৎপর। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই গত ১৪ বছরে নানা উপায়ে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। অর্থের শক্তিতে তারা এলাকায় নিজ-নিজ বলয়ও গড়ে তুলেছেন। অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কেউ কারও থেকে কম নন। বলা যেতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঊনিশ-বিশ। ফলে কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। অর্থ ও বলয়ের এই প্রতিযোগিতার কারণে আগামীতে মনোনয়ন প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে জেলায়-জেলায়, আসনে-আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে এরইমধ্যে কোথাও কোথাও সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। গত শনিবার নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে গুলি করার ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ দলীয় সেখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূইয়া মোহন ও সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লার দ্বন্দ্ব। মোহন ও মোল্লা দুইজনই ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে একে অপরকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মাঠ ফাঁকা করতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দলের স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছে। জেলার আটটি আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সাতজনের সঙ্গেই তাদের নিজ এলাকার নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় সংসদ সদস্যের সমর্থকদের সঙ্গে ইতোমধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি মিছিল-সমাবেশও হয়েছে। একাধিক সংসদ সদস্য জানান, স্থানীয় নেতাদের অনেকেই আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাই তারা পরিকল্পিতভাবেই সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে নেমেছেন। এতে দিনশেষে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে দলের। শুধু শিবপুর কিংবা টাঙ্গাইলেই নয়- এমন চিত্র আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ আসনেই।

দলীয় দ্বন্দ্ব-কোন্দল-সংঘাতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে সময়ে-সময়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের সময় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছিল। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে- এমন কথাও বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘বিদ্রোহীরা’ কেন্দ্রের এই হুঁশিয়ারিকে আমলে নেননি কিংবা গুরুত্ব দেননি।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে অনেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করলে ধন্দে পড়েন ভোটাররা এবং দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। দলীয় শৃঙ্খলা অনুযায়ী দল সমর্থিত একক প্রার্থীকে তারা ভোট দেবেন কিংবা তাদের পক্ষে প্রচারণা চালাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেউ কেউ যখন নির্বাচিত হন এবং দলও তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং বরণ করে নেয়- তখন বিপাকে পড়েন ভোটাররা এবং স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে যিনি নির্বাচিত হন তিনিও দলেরই লোক, কিংবা স্থানীয় কোনো না কোনো পর্যায়ের নেতা, কোথাও কোথাও তারা প্রভাবশালীও বটে। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা না করায় দল অতীতে বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখন আর কেন্দ্রের সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিতে চান না বিদ্রোহীরা।

আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, অতীতেও জেলা পরিষদ, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল- বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি এমনও বলা হয়েছিল, দলের যেসব সংসদ সদস্য বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করবেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে দুই-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং নির্বাচন শেষে দেখা গেছে, বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়ে দ্বিগুণ প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে এলাকায় রাজনীতি করছেন, দলও তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের মতে, অতীতে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আগামী সংসদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি দেখা দিতে পারে। কারণ, অতীতের ঘটনাপ্রবাহে বিদ্রোহীদের এমন বিশ্বাস জন্মেছে যে দলের কেন্দ্র থেকে যত শক্ত কথাই বলা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আসলে কিছু হবে না। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলছেন, যদি বিদ্রোহীদের ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ভোটের আগে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়ারও বা দরকার কী। দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় যদি সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাতে বরং দলের শৃঙ্খলা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেয়।

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশি-বিদেশিরা। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। জানা গেছে, বিএনপি ভোটে না এলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন আসনে দলের ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর কৌশল নেওয়ার চিন্তা করছে। কিন্তু এই কৌশল নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা ও বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, ডামি প্রার্থীদের কারও কারও আর্থিক ও পেশিশক্তির কারণে বিপাকে পড়তে পারেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মূল প্রার্থী। নানা উপায়ে কামানো অর্থের প্রভাবে ডামি প্রার্থীদের কেউ কেউ নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসন ও নেতা-কর্মীদের ম্যানেজ করে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করে দিতে পারেন। গত ১৪ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে কোথাও কোথাও এমন ঘটনা ঘটেছেও।

রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে, জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের সকল স্তরের নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগাগোড়া পুরো দায়িত্বে থাকেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে। ভোট কেন্দ্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষককরাও থাকেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক প্রমাণ করতে ডামি প্রার্থী করা হলে তাদের কেউ কেউ ভোটের মূল দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন পন্থায় প্রভাবিত করতে পারেন।

রাজনীতি