নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারে অনড় বিএনপি

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারে অনড় বিএনপি

নজরুল ইসলাম

দশ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করলেও শেষ পর্যন্ত দুটি দফার ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না বিএনপি। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপন করা- এ দুটি দাবির বিষয়ে অনড় থাকবে দলটি। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন মনোভাবের কথাই জানা গেছে। দলের নেতারা বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের চলমান আন্দোলনে তাদের এ পর্যন্ত ১৭ নেতাকর্মী মারা গেলেও আন্দোলনে গতি কমেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে। চলমান আন্দোলনের প্রতি বিদেশিদেরও সমর্থন আছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশিরা অনেক দিক থেকে আমাদের সমর্থন দিচ্ছে। কয়েক দিন আগে বিরোধী দলের ব্যাপারে জাতিসংঘ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা ও ইইউসহ সবাই বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হতে গেলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে।’

গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশ থেকে দশ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এর মধ্যে প্রথম দিকের দুটি দাবি ছিল জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ এবং ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ এর আলোকে দল নিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা। গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, সংসদ বিলুপ্ত করে এই সরকার পদত্যাগ করলে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বাকি আট দফা দাবি ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করার স্বার্থেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমাধান হবে। এটা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিজের স্বার্থে বাস্তবায়ন করবে বলে মনে করেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, চলমান যুগপৎ আন্দোলন ঘোষণার আগে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখাও প্রস্তুত করে দলটি। সেখানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার একজন প্রধান উপদেষ্টা ও অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। বিএনপির ওই খসড়ায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, আন্দোলনের মাত্রা একটি পর্যায়ে নিয়ে গেলে দলীয় ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে এই রূপরেখা ঘোষণা করা হবে।

২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ। এ রায়কে ভিত্তি ধরেই সংবিধান
সংশোধন করে সরকার, যাতে বিলুপ্ত হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ রায় অনুযায়ী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতেই পারে। এ বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

বিএনপি নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও চলমান যুগপৎ আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম নেতা মো. শাহজাহান বলেন, গত দুটি নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিএনপিসহ বিরোধী দলহীন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৫৪টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা আগের রাতেই করে ফেলে। এছাড়াও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই হাল। অর্থাৎ দেশে-বিদেশে সবার বিশ্বাস, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না।

গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেশব্যাপী যুগপৎ আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা ৫৪টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। এই আন্দোলনের সঙ্গে বাম ও ইসলামী দলগুলোকেও কাছে টানতে কাজ করছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
বিএনপি নেতারা বলেন, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করছে। আরও মানুষকে সম্পৃক্ত করতে দলের বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিদের উজ্জীবিত করতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ পর্যন্ত রংপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল এবং সর্বশেষ গতকাল ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের দল সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তারেক রহমানসহ দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

এসব বৈঠক সূত্রে জানা যায়, তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধিরা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি হঠাৎ করে আন্দোলন বন্ধ করা এবং কোনো দাবি আদায় ছাড়াই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যাবে না। মাঠে গুজব আছে, আগামী নির্বাচনে গেলে বিএনপিকে ৭০-৮০ সিট দেওয়া হবে। এ ধরনের লোভ পরিহার করে আন্দোলনের পথে থাকতে হবে। সে অনুযায়ী ঢাকাসহ সর্বত্র আন্দোলনমুখী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। মাঝপথে আন্দোলন থামিয়ে কোনো দাবি-দাওয়া আদায় ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দেশের মানুষ বিএনপির প্রতি আস্থা হারাবে। তৃণমূলের এই বক্তব্যের স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন নীতিনির্র্ধারকরা। তৃণমূলের এসব নেতাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, আপনাদের এখন থেকেই চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ‘সরকার এবং নির্বাচন’ কমিশন গঠন ছাড়া কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না।

দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, আন্দোলনের জন্য মাঠ প্রস্তুত আছে। দেশের মানুষও চায় বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনে যাক। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও দুর্বল নয়- এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মোকাবিলা করেই বিএনপিকে আন্দোলনে সফল হতে হবে। সে পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় এবং মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় আছে বিএনপি।

গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপি দলীয় এমপিদের জাতীয় সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ এবং ১০ দফা দাবিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে ৫৪টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন রাজপথে একযোগে কর্মসূচি পালন করছে। এটাকে আন্দোলনের বড় সফলতা হিসেবে দেখছেন বিএনপি নেতারা। তাদের ভাষ্য, সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যেও চলমান যুগপৎ আন্দোলনে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সরকার চাপে পড়েছে। যার কারণে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও বিএনপিকে নিয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা বা না পারা ইস্যুটি নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সামনে আনছেন। তবে দলীয় নেতাদের ভাষ্য, দলের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতেই খালেদা জিয়ার ইস্যুটিকে সামনে আনা হয়েছে।

বিএনপির ১০ দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। আমরা মনে করি, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে তা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সংসদ বিলুপ্ত করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সেই নিরপেক্ষ সরকার সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে।

রাজনীতি