অনলাইনে জমজমাট আসর বসছে জুয়ার। জুয়ায় ব্ুঁদ হচ্ছে তরুণরা। অনলাইন জুয়া পরিচালনা হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাইট থেকে। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে এসব সাইটের তথ্য। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে উড়ছে কোটি কোটি টাকা। এই টাকার একটি অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। জুয়াড়ি চক্রের সদস্যরা মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগই থাকছে অধরা।
টিকটকার প্রত্যয় হিরন স্কুলের গণ্ডি পেরুলেও পরবর্তীতে আর পড়াশোনা করেননি। নিজের টিকটক ও ভিডিও কনটেন্টে জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারে জড়িয়ে পড়েন। প্রতি পর্বের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিতেন টিকটকার প্রত্যয়। পরে সেই বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো টিকটক, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এসব কনটেন্টে হিরনের সঙ্গে অভিনয়ে থাকতেন রায়হান সরকার বিশাল। জুয়া ও বেটিং কোম্পানির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন চক্রের অন্যতম সদস্য আবদুল হামিদ।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, চক্রের মূলহোতা হামিদ জুয়া ও বেটিং সাইটের এজেন্টদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে শুরুতে নিজেদের ইউটিউব আইডি দিয়ে প্রচারণা চালাতেন। কিন্তু তাদের আইডি থেকে সেভাবে ভিউ না হওয়ায় পরবর্তীতে কথিত টিকটকার-ইউটিউবারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দিয়ে বিজ্ঞাপনসহ নানান প্রচারণা শুরু করেন। অনলাইনভিত্তিক অন্তত ৩টি জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন প্রত্যয় ও তার সহযোগীরা। তাদের বয়স ২২ থেকে ২৪ এর মধ্যে। এই চক্রের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুয়াড়ি চক্রকে ধরতে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রের মূল প্ল্যাটফরমের নাম ‘দি আজাইরা লিমিটেড’। ইউটিউবে এই চ্যানেলের মূল নিয়ন্ত্রক প্রত্যয় হিরন। এসব প্ল্যাটফরমের জন্য ‘ওয়েব সিরিজ’ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করতেন প্রত্যয় ও তার সহ-অভিনেতা বিশাল। তেমন একটি ওয়েব সিরিজ ‘বদমাইশ পোলাপাইন সিজন-৪’। এই ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের মাধ্যমে জুয়া ও বেটিং সাইটের প্রচারণা চালাতেন প্রত্যয় ও বিশাল। পাশাপাশি সরাসরি বিজ্ঞাপন প্রচার এবং কনটেন্টের ‘ডেসক্রিপশন বক্স’-এ জুয়া ও বেটিং সাইটের লিঙ্ক প্রকাশের মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন প্রচার করতো এই চক্র।
গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে প্রত্যয় তার ভুল বুঝতে পেরেছে মর্মে জবানবন্দি দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেন না। ২০২১ সালের ১০ই মে রাজধানীর খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি ব্যবহার করে ক্যাসিনো প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গত বছর খিলক্ষেত এলাকা থেকে অনলাইনে জুয়া পরিচালনাকারী বাংলাদেশের ২ মাস্টার এজেন্টসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি-সাইবারের ওয়েববেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম ও অর্গানাইজ ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
অনলাইন জুয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, অনলাইন জুয়ার একেকটি আলাদা বেটিং সাইট বা ওয়েবসাইট রয়েছে। এসব ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে প্রথমেই একজন ব্যক্তিকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। রেজিস্ট্রেশনের পরে ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অঙ্কের একটি ব্যালেন্স যোগ করতে হয়। বিকাশ-রকেটসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট নম্বরে টাকা পাঠালে ব্যালেন্স যোগ হয়ে যায়। এড হওয়ার পরে সাইটগুলোতে বিভিন্ন ধরনের লটারি রয়েছে যেগুলোতে পছন্দ অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট হোল্ডার খেলতে পারেন। এক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি জিতলে অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স জমা হবে। আর হেরে গেলে টাকা চলে যাবে। আমাদের দেশে অনলাইন-অফলাইন সকল ধরনের জুয়ার ফরমেটই নিষিদ্ধ। অফলাইন জুয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্য জুয়া নিরোধ আইনে এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে।
বেশির ভাগ জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। দেশে যারা কাজ করেন তারা এজেন্ট। গত বছর একটি জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী এক ব্যক্তিকে জামালপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। যিনি একাই ১৮০টি জুয়ার সাইট পরিচালনা করতেন। ১৮৮, বাবু, ক্রিকেট এসব জুয়ার সাইটগুলো দেশের বাইরে বসে পরিচালিত হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ বলেছে, চক্রের সদস্যরা গ্রাহক জোগাড় করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার আসরের অবৈধ অর্থের লেনদেন করেন। তাদের ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মেলে। গত বছর অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে পাওয়া ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন তারা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
অনলাইন জুয়া রোধে প্রচলিত আইন কার্যকর নয়। দেশে প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা অবৈধ। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী ৩ মাসের কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এসব স্থানে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি ১ মাস পর্যন্ত কারাদ- বা ১০০ টাকা অর্থদ- বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ১৫৬ বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে একে যুগোপযোগী করা জরুরি বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ মানবজমিনকে বলেন, অনলাইন জুয়া অনেকটা মাদকের নেশার মতো। আর এসব নেশায় আসক্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও রয়েছে। অনলাইন জুয়ায় অংশগ্রহণকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ ধরনের জুয়া রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অনলাইনে সাইবার মনিটরিং করে যাচ্ছে। বেশির ভাগ এজেন্টরাই দেশের বাইরে বসে জুয়ার সাইট পরিচালনা করায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।