রোজা ঘিরে অর্থলোভীর থাবা

রোজা ঘিরে অর্থলোভীর থাবা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে গত বছর বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে দেশের বাজারেও। কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমলেও দেশে দেখা যাচ্ছে উল্টোচিত্র। সয়াবিন ও চিনির মতো পণ্যে ব্যবসায়ীরা শুল্ক সুবিধা ভোগ করলেও ভোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে আসন্ন রমজান মাস ঘিরে বাজারে থাবা বসাচ্ছেন অতিরিক্ত মুনাফালোভীরা। এতে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন নিম্নআয়ের মানুষ। দুশ্চিন্তায় মধ্যবিত্তও।

রোজায় দ্রব্যমূল্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিতের লক্ষ্যে অসাধু চক্রদের ঠেকাতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। রোজার মাসে ‘কালোবাজারি, মজুদদাররা’ যাতে বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে না পরে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পণ্যের সংকট সৃষ্টির চেষ্টাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অপরদিকে সরকারি একাধিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে বরাবরের মতো ‘দাম বাড়বে না’ বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ বাজারে এসবের কোনো প্রভাব পড়ছে না। রোজার আগেই প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের চলতি মাসের প্রতিবেদন বলছে, গত বছর এপ্রিল-জুনে এক মেট্রিক টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৮৮৭ ডলার। একই পরিমাণ গমের দাম ছিল ৪৯২ ডলার। সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমে এক মেট্রিক টন সয়াবিন ও গমের দাম হয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৩৫২ ডলার এবং ৩৮০ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে যা আরও কমেছে। অপরদিকে চিনির দাম খুব একটা না কমলেও নতুন করে বাড়েনি। এপ্রিল-জুনে প্রতিকেজি চিনির দর ছিল দশমিক ৪৩ ডলার, যা চলতি বছর জানুয়ারিতে দশমিক ৪২ ডলারে নেমেছে। অথচ দেশের বাজারে সয়াবিন তেল ও চিনির দাম কমেনি। চিনির সংকটও মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে।

সরকার চিনি ও সয়াবিন তেল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা ভোগ করলেও ভোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না। কিছুদিন আগে এক কেজি চিনি ১১০ টাকায় পাওয়া গেলেও রোজার সামনে হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খোলা চিনি ১০৭ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অপরদিকে সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়। গমের দাম না কমায় বাজারে খোলা আটার কেজি এখন ৬০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা এলসি জটিলতা ও আমদানি কমের অজুহাত দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রমজান মাসে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্য আমদানিতে যথেষ্ট পরিমাণ ঋণপত্র খোলা হয়েছে। সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে এসব পণ্যের কোনো সংকট হবে না।

চিনি, ছোলা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও খেজুর- এ পাঁচটি পণ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারিতে ৫ লাখ ১১ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। আর চলতি বছর জানুয়ারিতে খোলা হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪১ মেট্রিক টনের। গত বছরের জানুয়ারিতে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৯ মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের ঋণপত্র খোলা হয়, যা গত জানুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৩ মেট্রিক টন।

পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা জানান, সরকার দাম বেঁধে দিলেও আমাদের বেশি দামেই কিনতে হয়। পণ্য ক্রয়ের রসিদে এখনো গরমিল রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোজ্যতেল, চিনি, আটাসহ অনেক আমদানি পণ্যে গুটিকয়েক বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের বাজার জিম্মি হয়ে আছে। এরাই সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের বাজারে বিশ্ববাজারের প্রভাব পড়তে অন্তত মাস দেড়েক সময় লাগে। অথচ দাম বাড়ার সময় রাতারাতি বাড়ে; আর কমার বেলায় কমতেই চায় না।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দেশে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা নেই। হাতেগোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান অনেকগুলো আমদানিপণ্যের বাজার দখল করে আছে। নানা জটিলতায় নতুন ব্যবসায়ী সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারেন না। এক ট্রেড লাইসেন্স করতেই নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নতুন কেউ ব্যবসায় এলেও বড়দের কারসাজিতে টিকতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকলে শুল্ক প্রত্যাহার কেন, কোনো সুবিধারই সুফল ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছবে না।

বাজার নজরদারিতে বড় গলদ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে নজরদারি মানে খুচরা বা পাইকারি ব্যবসায়ীকে গিয়ে জরিমানা করা। এটাকে আসলে মনিটরিং বা নজরদারি বলে না। এতে হাতেগোনা কয়েকজন খুচরা কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রকৃত মনিটরিং হচ্ছে আমদানিতে খরচ হলো কত, সরবরাহে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়, মজুদ থাকলে কী পরিমাণ রয়েছে, পণ্যটিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার রয়েছে কিনা- এসব বিষয় মনিটরিং করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের এলসি খোলার পরিমাণ সন্তোষজনক। জানুয়ারিতে ২৯ হাজার ৪৮১ মেট্রিক টন খেজুরের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ১৬ হাজার ২৯৮ মেট্রিক টন।

অবশ্য বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খেজুরের দাম সম্প্রতি বেড়েছে। পাইকারিতে খেজুরের দাম প্রতি পাঁচ কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তি বলে জানিয়েছেন রাজধানীর বাদামতলীর খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হালিমা ট্রেডার্সের মো. কাকন।

বাংলাদেশ ফ্রেস ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি ভালো হলেও ডলারের বাড়তি দামের জন্য খেজুরের দাম বেশি পড়তে পারে। এদিকে আমদানি কমের অজুহাতে বাজারে ছোলার দাম বেড়ে ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। মাস দেড়েক আগেও ছোলার কেজি ৮৫ টাকা ছিল। আর গত রমজানের সময় ছিল ৭০ টাকা।

গরিবের অ্যাংকর ডালের দামও বেড়ে ৭৫ টাকা হয়েছে, জানুয়ারিতে যা ৬৫ টাকায় পাওয়া গেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল ৪৮ টাকা। মসুর ডালের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা হয়েছে (দানাভেদে)।

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ জানান, রোজায় বাড়তি চাহিদা পূরণে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইথিওপিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে ডালের আমদানি বাড়ায় আমদানিকারকরা। কিন্তু বর্তমানে ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে আমদানি অনেক কমেছে। গত রোজার তুলনায় এবার পাইকারিতে ছোলার দাম ২২ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে।

বরাবরের মতো এবারও রোজার আগে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের বৈঠক হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা আশ^স্ত করেন, রোজায় তারা দাম বাড়াবেন না। অথচ বাজারে তার ছাপ পড়ছে না।

দেশে ভালো ফলন ও আমদানি বাড়লেও চালের দাম কমেনি। প্রতিকেজি মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি ৫৮ থেকে ৬২ টাকা এবং সরু চাল ৭০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখানেও অভিযোগ, বড় মিল ও করপোরেট কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি শুল্ক সুবিধাও কোনো প্রভাব ফেলে না।

একইভাবে পোল্ট্রি খামারিরা বলছেন, কয়েকটি বড় করপোরেট চক্রের কারসাজিতে ব্রয়লার ও ডিমের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ব্রয়লারের কেজি এখন ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা এবং ডিমের ডজন ১৪০ টাকা, যা নিম্নআয়ের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম কমে। আর আমাদের এখানে বাড়ে। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যবসায়ীদের লোভস্ফীতি বেশি ভয়ানক। বাজার ব্যবস্থায় ফাঁক রয়েছে, মনিটরিংয়ে বড় ত্রুটি রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার নেই। কী দরে, কত পরিমাণ আমদানি হয়েছে তার তথ্য রয়েছে, কিন্তু কী দামে বিক্রি হচ্ছে, কার কাছে কত মজুদ রয়েছে, সরবরাহ কতটুকু হচ্ছে, তার হিসাব রাখা হচ্ছে না।

এদিকে রোজা শুরুর আগেই বেগুনের দাম বাড়তে শুরু করেছে। একইভাবে বেড়েছে শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত লেবুর দামও। এখনই প্রতি হালির দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। মাছের বাজারেও স্বস্তি নেই।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সয়াবিন, চিনি, ছোলা, খেজুর ও লবণÑ রমজানের এই পাঁচ পণ্যের দাম এক বছরে গড়ে ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয়