বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির রসায়ন ঠিকঠাক থাকলে আর ৯ মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ময়দানে দৃশ্যমান ও ঘোষিত প্রতিপক্ষের চেয়েও আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে গত ১৪ বছরে দলে অনুপ্রবেশকারী রাজাকার-শান্তি কমিটি-আলবদর-আল শামসের পোষ্য ও দোসররা।
এই দোসররা অর্থের বিনিময়ে ঢুকে পড়েছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে। টাকার বিনিময়ে জেলা-উপজেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদও বাগিয়েছেন তারা। পদ বাগিয়ে নানা অবৈধ পন্থায় কামিয়েছেন অঢেল অর্থ। সেই অর্থের বিনিময়ে তারা স্থানীয় প্রশাসনেও আধিপত্য বিস্তার করছেন। অনুপ্রবেশকারীরা এবং প্রশাসনের এই অংশটি টার্গেট করেছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে। নির্বাচনে সরকার ও আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলতে যৌথভাবে তত্পর হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্রটি। কয়েক দিন আগে রাজধানীর মিরপুরে জামায়াত-শিবিরের গোপন বৈঠক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তাসহ দুই জন সরকারি কর্মকর্তা গ্রেফতারের ঘটনাকে সেটিরই আলামত মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে কৌশলে অনুপ্রবেশ করেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পোষ্যরা। অর্থের বিনিময়ে পদে ঢুকেই পর্যায়ক্রমে তারা দলের স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্রসহ যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। রাতারাতি মালিক বনেছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের। দলীয় পদ আর অঢেল অর্থের যৌথ প্রভাবে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে গেলে এখন তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। দল টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এখন তারা রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর দাপটের কাছে অনেকটা অসহায় বা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দলের প্রকৃত ও বহু বছরের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বারবারই দলে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, যত অপকর্ম এই অনুপ্রবেশকারীরাই ঘটাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও নিয়মিতই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বলছেন। দলের প্রকৃত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা যাতে কমিটিতে স্থান পান—সে বিষয়েও তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নসহ তৃণমূলের বিভিন্ন কমিটিতে কেন্দ্রীয় সেই নির্দেশনার প্রতিফলন পুরোপুরি ঘটেনি। নানা কৌশলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতরা ঢুকে পড়েছেন। বিএনপি, জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টি, এমনকি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও কেউ কেউ জার্সি বদলে কোথাও কোথাও অনুপ্রবেশ করেছে। সম্প্রতি এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
টাকার বিনিময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছেন রাজাকারদের পোষ্যদের কেউ কেউ। কোনো কোনো এলাকায় তাদের ভয়ে দলের অন্য কেউ দরপত্রে অংশ নেওয়ারও সাহস করেন না। শুধু সরকারি দরপত্র নিয়ন্ত্রণই নয়, এলাকায় চাঁদাবাজি ও ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ব্যবসাও করছেন এই অনুপ্রবেশকারী যুদ্ধাপরাধীদের ছেলে-নাতি-স্বজনসহ পোষ্যরা। তাদের অর্থ আর দলীয় পদের প্রভাব বলয়ের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে গেলে অসহায়। কোথাও কোথাও এমন ঘটনাও ঘটেছে যে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করায় অন্যত্র বদলি হতে হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। দিনে দিনে এই অনুপ্রবেশকারীদের হাত এত লম্বা হয়েছে যে, অনুগত না থাকলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও অন্যত্র বদলি করে দেন।
অনুপ্রবেশকারীরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন টাকার বিনিময়ে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থের বিনিময়ে তারা থাকছেন অধরা। কোনো কোনো এলাকায় এমন ঘটনাও রয়েছে, সরাসরি খুনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও তারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অর্থের দাপট দেখে বিস্মিত খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই প্রশ্ন—এই অর্থের উত্স কী? আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার লক্ষ্যে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তির সংযোগ রয়েছে কি না, এমন সন্দেহও পোষণ করছেন দলের নেতাকর্মীরা। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা কোনো শক্তি নেপথ্যে এদের অর্থের জোগান দিচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিক সময়ে এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারীরাই দল ও সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। সুসময়ের বসন্তের কোকিল দুঃসময়ে থাকে না। দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা কখনো দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করে না। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন্য অনুপ্রেবেশকারীরাই দায়ী। তাই, আমি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলব, দলে কোনো স্তরে কোনোভাবেই অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।’
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী যুদ্ধাপরাধীদের পোষ্যরা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনও নিয়ন্ত্রণ করেছেন বা করছেন। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচনেও কৌশলে দলীয় মনোনয়ন নিচ্ছেন। কখনো দলের মনোনয়ন নিতে ব্যর্থ হলে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজেরা প্রার্থী হয়েছেন, কখনো পছন্দের অনুগত কাউকে প্রার্থী করে বিপুল অর্থ খরচ করে তাকে জিতিয়ে এনেছেন।
ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরেও ঘাপটি মেরে রয়েছে রাজাকার-শান্তি কমিটি-আলবদর-আলশামসের পোষ্য ও দোসররা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনে থাকা অভিন্ন আদর্শের লোকজন ও সমমনারা। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই প্রশাসনের ভেতর-বাইরের রাজাকারদের পোষ্য ও দোসররা সংঘবদ্ধ তত্পরতা জোরদার করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলা।
একাধিক সূত্রের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মহলে থাকা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের পোষ্যরা অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনে থাকা অনুসারীদের কাছ থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বের করে নিচ্ছেন। সেসব তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে দেশেবিদেশে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে থাকা বিভিন্ন মহলের কাছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে সরকারবিরোধী যে শোডাউন হয়েছে, সেখানেও কৌশলে অর্থ ও লোকবলের জোগান দিয়েছে চক্রটি।
তথ্য বলছে, রাজাকার-শান্তি কমিটি-আলবদর-আলশামসের পোষ্য ও দোসররা নানা কৌশলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদও বাগিয়ে নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার পর তারা টেন্ডারসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মহলে থাকা অনুসারীদের। একদিকে নিজেরা যেমন প্রশাসনে থেকে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, আবার সরকারবিরোধী তত্পরতা চালাতে দরপত্রের কার্যাদেশ ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন সমমনাদের। জানা গেছে, সরকারের জন্য এখন সব থেকে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমগ্র প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে থাকা রাজাকার-শান্তি কমিটি-আলবদর-আলশামসের পোষ্য ও দোসররা। কারণ আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে, সংঘবদ্ধ এই চক্রটি সরকারকে বিপাকে ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে বহুমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সম্প্রতি বলেছেন, ‘প্রশাসনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা বসে আছে। ১৯৭৫-এর পর থেকে তারা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বহু নথিপত্র তারা টেম্পারিং করেছে, বিকৃত করেছে।’
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার জন্য দেশের ভেতরে এবং উন্নয়ন-সহযোগী কিংবা প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছ থেকে এক ধরনের চাপ অনুভব করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি শেষ পর্যন্ত না এলেও নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে দল মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি প্রতিটি আসনে অন্তত দুই জন করে ডামি প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নেওয়া হবে। অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও এবং দল থেকে বহিষ্কারের পর যারা ক্ষমা পেয়েছেন—তারা এবং ডামি প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীর মোড়কে। বিএনপি না এলে নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে যেহেতু অধিক প্রার্থিতাকে উত্সাহিত করা হবে, সেই সুযোগে সিংহভাগ আসনে আওয়ামী লীগের অনেকে দলের অনুমতি না পেলেও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হতে পারেন।
সেক্ষেত্রে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এবং আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে পদ-পদবি বাগিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া রাজাকারদের সন্তানরা কৌশলে বিভিন্ন আসনে নিজেদের পছন্দের লোককে প্রার্থী করে সরকারকে বিপাকে ফেলতে পারে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের মূল প্রার্থীকে পরাজিত করে নিজেদের আদর্শের লোককে জিতিয়ে আনতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করাসহ ব্যাপক তত্পরতা চালাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে পুরো নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে দলে অনুপ্রবেশকারী রাজাকার-সন্তানরা এবং প্রশাসনে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি।