অবৈধ পার্কিং ঘিরে চলছে চাঁদাবাজি যত্রতত্র পার্কিং ও ফুটপাত দখলে যানজট বেড়েছে

অবৈধ পার্কিং ঘিরে চলছে চাঁদাবাজি যত্রতত্র পার্কিং ও ফুটপাত দখলে যানজট বেড়েছে

রাস্তা তুমি কার?- এমন প্রশ্নের উত্তর যদি নিউমার্কেট বেচারি সড়ক দিতে পারত, তাহলে বলত- ‘আর যাই হোক পথচারীদের নয়।’ হকারদের ঝুপড়ি, স্থায়ী দোকানের বর্ধিত অংশ, গাড়ির অবৈধ পার্কিং শুধু নিউমার্কেট সড়কে নয়; রাজধানীজুড়ে বিরাজ করছে।

ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। সেই তুলনায় ঢাকায় নতুন কোনো রাস্তা তৈরি হয়নি। উল্টো যে রাস্তাগুলো রয়েছে, তান্ডও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। তার উপরে শহরের রাস্তায় অবৈধ গাড়ি পার্কিং। কোথাও কোথাও চলছে রাস্তা দখল করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ‘পার্কিং ফি’ নেওয়ার ব্যবসা। দিন কিংবা রাত, সবসময়ই অবৈধভাবে রাস্তায় পার্কিং করা থাকছে গাড়ি। বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা এসব অবৈধ পার্কিং ঘিরে চলে চাঁদাবাজি। বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমাধানের দেখা মেলেনি কখনো।

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, যানবাহন চালক ও যাত্রীদের মতে, এমন অসহনীয় যানজটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো ঈদের কেনাকাটার জন্য বিপণিমুখী যানবাহনের চাপ। নগরের অনেক বিপণি বিতানে পার্কিং ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক বিপণি বিতানে পার্কিং ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও রিক্সা, অটোরিক্সা ও ব্যক্তিগত গাড়ির জট বাড়ছে পাশের রাস্তায়। এর ওপর যত্রতত্র পার্কিং ও ফুটপাত দখলও যানজট বাড়িয়েছে কয়েকগুণ।

রাজধানীর মুগদার ডিআইটি সড়কের আধা কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে ট্রাকের অবৈধ স্ট্যান্ড। এই সড়কের আইডিয়াল স্কুল গেট থেকে কমলাপুর টিটি পাড়ার মোড় পর্যন্ত হারিয়ে গেছে ট্রাকের তলে। অবৈধভাবে গজিয়ে ওঠা এই ট্রাক স্ট্যান্ডের কারণে রাজধানীর পূর্বাংশের খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা থেকে মানিকনগর হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত এলাকায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে রাজধানীর দক্ষিণাংশ থেকে উত্তরের দিকে যাতায়াতকারী যাত্রী ও পরিবহনগুলোকে যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

জানা গেছে, এসব ট্রাকের বেশিরভাগই কমলাপুরের আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে মালামাল পরিবহন করে। তবে আইসিডির নিজস্ব ট্রাক স্ট্যান্ডে জায়গা না থাকার কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুগদা-কমলাপুর রাস্তা দখল করেই পার্কিং করে রাখা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সড়কে ট্রাক ও পিকআপ রাখার কারণে ফুটপাত ও সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। আর আইডিয়াল স্কুলের সামনে বিশালাকারে ময়লার স্তূপের কারণে পরিবেশ একেবারেই যাচ্ছেতাই। এভাবে শত শত ট্রাক সড়কে পার্কিং করে রাখার কারণে ফুটপাতও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আর রাত হলেই টিটিপাড়া মোড় থেকে মুগদা আইডিয়াল স্কুল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা।

নিউমার্কেট এলাকায় যানজটের দৃশ্য নতুন কিছু নয়। নতুন করে এই এলাকায় যানজটের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে অবৈধ এ ট্যাম্পু স্ট্যান্ড। নীলক্ষেত মোড়ে গড়ে ওঠা এই অবৈধ ট্যাম্পু স্ট্যান্ডটি গড়ে তুলেছেন নিউমার্কেট গাড়ি পার্কিং ইজারা নেওয়া ১৮ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ফরমান মোল্লাসহ ছয়জন। তাদের দাবি, নীলক্ষেত মোড়ের ওই জায়গাটি তাদের ইজারা নেওয়া সীমানার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও পুলিশ বলছে, এটা মিথ্যা তথ্য।

ট্যাম্পু স্ট্যান্ড ছাড়াও নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতাদের গাড়ি জনবহুল এই সড়কেই পার্কিং করা হচ্ছে। অবৈধ এই পার্কিংয়ে এগিয়ে সরকারি আমলা, রাজনৈতিক প্রভাবশালী অনেকেই। অথচ এখানে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য, সার্জেন্টরা প্রতিমুহূর্ত দায়িত্ব পালন করছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) জয়নাল আবেদীন জনকণ্ঠকে বলেন, ওই ট্যাম্পু স্ট্যান্ড তো আমি সরিয়ে দিয়েছি, আবার বসেছে। আচ্ছা আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

বাংলামোটর থেকে মগবাজার যেতে সিগন্যাল পয়েন্টের পরেই গড়ে উঠেছে একাধিক গাড়ি মেরামতের দোকান। মূল সড়কে অবৈধভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঠিকঠাক করা হয়। এতে প্রতিনিয়ত জটলা বাধে সিগন্যাল পয়েন্টটিতে। ফলে সিগন্যাল ছাড়ার পরও নির্বিঘে মগবাজারগামী গাড়ি দ্রুত যেতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে গড়ে ওঠা অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে বেশ কয়েকটি জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তার একটি অংশে দখল করে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও স্টাফ বাস পার্ক করে রাখে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। এ কারণে দুই লেনের এই রাস্তা সরু হয়ে এক লেনে পরিণত হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তেজগাঁওয়ের লাভ রোডের শমরিতা হাসপাতাল এবং আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি ও ভূমি অফিসের সামনে অবৈধ পার্কিং থাকছে সবসময়। বিজয় সরণি থেকে আসা গাড়ি প্রথম যানজটে পড়ে শমরিতা হাসপাতালের সামনে। হাসপাতালে আসা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, রোগীদের ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় রাস্তায় সৃষ্টি হয় যানজট। আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের আনা-নেওয়ার কাজ করে বিআরটিসির দ্বিতল বাস। সকালে শিক্ষার্থীদের আনার পর এই বাসগুলো রাস্তা দখল করে দুপুর পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীত পাশে অবস্থিত জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট। সেখানে আসা রোগীদের ব্যক্তিগত গাড়ি রাখা হয় হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। রাস্তার দুপাশে গাড়ির অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে এখানে রাস্তা হয়ে যায় সংকীর্ণ।

জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় বিএএফ শাহীন কলেজে সকাল সকাল অসংখ্য প্রাইভেটকার হাঁকিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আসেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ শিক্ষকরা। অথচ সেখানে নেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ফলে সকাল সকাল ওই সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। একই দৃশ্য মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের। ওখানে সেন্ট জোসেফ, প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজে আসা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূল সড়কে পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা আব্দুল্লাপুর, বনশ্রী, মালিবাগ, চিটাগাং রোডগামী একাধিক পরিবহনের বাস আসাদগেট হয়ে বের হতে গেলেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

কুড়িল ফ্লাইওভারের পূর্বপাশের রাস্তায় দিনের বেলায়ই পিকআপ, সিএনজি আর প্রাইভেট কারে ঠাসা থাকে রাস্তার প্রায় পুরোটা। রাতে এ সংখ্যা বেড়ে হয় কয়েকগুণ। যার ফলে এই এলাকা দিয়ে স্বাভাবিক চলাফেরায় অসুবিধা হয় আশেপাশের মানুষের।

গত কয়েক দিন নগরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, পিক আওয়ার বলে পরিচিত ব্যস্ততার সময় কেবল নয়, সারা দিনই নগরের প্রায় সব এলাকায় হচ্ছে যানজট। অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাব যে কতটা দুঃসহ হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ রাজধানীর পার্কিং ব্যবস্থা। এই শহরের ৯০ ভাগ ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা নেই। এতে রাস্তার দুপাশে বাস ও গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে সৃষ্ট প্রতিদিনের যানজটকে করে তুলছে অসহনীয়।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি আদর্শ শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় আছে মাত্র আট শতাংশ। যার মধ্যে যান চলাচলের জন্য ব্যবহার হয় মোটে পাঁচ শতাংশ। রাজধানীর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং। শুধু রাজধানীতে অবৈধ পার্কিং এর জন্য আনুমানিক ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আর দেশের বাকি মহানগরের হিসাব ধরলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এআরআই) এর পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, অবৈধ পার্কিং এর কারণে ঢাকার রাস্তার স্থায়িত্ব প্রায় অর্ধেক কমে যাচ্ছে। পার্কিং অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক সময় রাস্তার মধ্যে পার্কিংয়ের জন্য চালক জায়গা খুঁজতে থাকেন। এ অবস্থায় একদিকে যেমন অতিরিক্ত জ্বালানি অপচয় হয়, অন্যদিকে রাস্তায় চলাচলকারী অন্য গাড়িগুলোর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অবৈধ পার্কিং এর কারণে ঢাকার রাস্তার স্থায়িত্ব প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

ঢাকায় যেভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে তাতে আগামী কয়েক বছর পর ঢাকার মূল সড়কের সমান জায়গা লাগবে শুধু পার্কিংয়ে। বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, দেশে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি প্রাইভেট গাড়ি রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে। রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য গুলশান ও বনানী এলাকার মতো সমান জায়গার প্রয়োজন হবে। সে হিসাবে শুধু ৪০০ কিলোমিটার সড়ক লাগবে পার্কিংয়ের জন্য। যেখানে ঢাকায় মূল সড়কই আছে ৪০০ কিলোমিটার। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি পার্কিং এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।

রাজধানীর সড়কগুলো দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। উত্তর সিটি করপোরেশন ২/১টি জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে উঠা পার্কিং উচ্ছেদ করলেও দক্ষিণে এর কোনো নমুনাই নেই। দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, বর্তমানে ডিএনসিসিতে অস্থায়ী পার্কিং জোন রয়েছে ৩১টি। আর ডিএসসিসি এলাকায় একটি স্থায়ী ও ২২টি অস্থায়ী পার্কিং জোন রয়েছে। অস্থায়ী পার্কিং জোনের বেশিরভাগই করা হয়েছে রাস্তার ওপর।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান  বলেন, অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে যে যানজট সৃষ্টি হয়, তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন পুরনো। কিন্তু নতুন করে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা ভবনেও পর্যন্ত পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ফলে দিনের বেলায় এদিক-সেদিক করে গাড়ি রাখা হলেও সন্ধ্যা হতেই রাজধানীজুড়ে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা হয়। এতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এগুলো বেশি হয় প্রধান সড়কের আশপাশে যেসব শাখা সড়ক আছে, সেখানে। আমরা সব সময় এই অবৈধ পার্কিংকে নিরুৎসাহিত করি। এমনকি আমরা অনেক জায়গায় নিয়মিত জরিমানাও করি। কিন্তু স্থায়ী কোনো কাজ হয় না। আসলে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের অবকাঠামো তৈরি না করলে এই সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান হচ্ছে না।

জাতীয়