প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, দেশের উন্নয়কে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমবায়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করার জন্য এই আন্দোলনকে দেশের কৃষিক্ষেত্রের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৪৭তম জাতীয় সমবায় দিবস এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার ২০১৬ এবং ২০১৭ বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে একথা বলেন।
নেতৃত্ব সৃষ্টি, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সমবায়ের সঙ্গে অধিকহারে নারীদের সম্পৃক্ত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সমবায় বিভাগ আয়োজিত সমবায় পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে ১০টি ক্যাটাগরিতে সমবায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় দু’বছওে মোট ২০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক গ্রহণ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।
সমবায়ের ভিত্তিতে চাষাবাদে জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমবায় ভিত্তিক কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমাদের করা উচিত এইজন্য যে, আজকাল সকলেই লেখাপড়া শেখে, চাকরি করে, দেশে-বিদেশে চলে যায়। জমি কিন্তু অনাবাদী পড়ে থাকে। আমাদের যেহেতু দেশের মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে তাই আমাদের লক্ষ্য থাকবে এই জমি যেন অনাবাদী পড়ে না থাকে।
তিনি জাতির পিতার ভাষণ থেকে ‘আমাদের দেশের জমি এত উর্বর যে বীজ ফেললেই গাছ হয়, গাছ হলে ফল হয়। সেদেশের মানুষ কেন ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাবে’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কাজেই আমরা এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখবো না। আর অনিবাসীদের জমিগুলো উৎপাদনের আওতায় আনতে গেলে আমরা সমবায়ের মাধমেই তা আনতে পারি। সেক্ষেত্রে মালিক যেমন তার অংশ পাবে তেমনি বেশি অংশ পাবে যারা শ্রম দিচ্ছে তারা। আর একটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী সমবায় পাবে।
তিনি বলেন, এইভাবে একটা নীতিমালা তৈরি করে আমরা যদি আমাদের সমস্ত জমি চাষ করতে পারি বা উৎপাদন বাড়াতে পারি তাহলে আমাদের দেশে আর কখনই কোন খাদ্যের অভাব হবে না।
এলজিআরডি এবং সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দোকার মোশাররফ হোসেন, প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. কামাল উদ্দিন তালুকদার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
বাংলাদেশ সমবায় ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নাদির হোসেন লিপু, সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং নিবন্ধক মো. আব্দুল মজিদও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
একমাত্র সমবায়ের মাধ্যমেই দ্রুত উন্নয়ন করা সম্ভব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কারণেই জাতির পিতা সমবায়কে আমাদের সংবিধানের অর্থনৈতিক নীতিমালায় সংযুক্ত করে গেছেন, সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে।
তিনি বলেন, সমবায় ছিল জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার। তিনি কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প উদ্যোগ, কৃষি ঋণসহ সবক্ষেত্রেই সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনা প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন।
জাতির পিতার কন্যা বলেন, জাতির পিতা সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্থান দেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি সমবায় সমিতি এবং মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গঠন করেন। তিনি তাঁতী সমবায় সমিতি ও শিল্প সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। আজ বাংলাদেশের অন্যতম সমবায় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা জাতির পিতার হাতেই গড়া ।
গ্রামীণ জনপদ থেকে দারিদ্র্য নির্মূলের লক্ষ্যে ৮১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ৮৭ হাজার গ্রামে ৮২ হাজার ৩৯৫টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়েছে। উপকারভোগী সদস্য পরিবার ৩৮ লাখ ৮১ হাজার ২৪০।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা নিয়ে এ প্রকল্পের উপকারভোগীগণ ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে।
আমরা দরিদ্র জনগণের জন্য ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছি, যোগ করেন তিনি।
তাঁর সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমবায় একটি সম্ভবনাময় শক্তি উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। যার সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৯ লাখ এবং মোট কার্যকরী মূলধনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
কৃষিভিত্তিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পর কৃষিভিত্তিক গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছিল বলেই তার সুফল আজকে দেশবাসী পাচ্ছে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, তরিতরকারি উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, ফলমূল উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম স্থান অধিকার করে আছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশে অধিকহারে খাদ্য প্রক্রিয়াজাকরণ শিল্প গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, উৎপাদিত খাদ্যশস্যকে উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজত করতে পারলে বাজারজাত করণের সুবিধা হবে আবার বিদেশের পাঠানো যাবে। কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে তাহলে আমাদের দেশে কোন মানুষ আর দরিদ্র থাকবে না।
আমরা দরিদ্রের হার ইতোমধ্যে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দারিদ্রের হার ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি এবং আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আরো ৪ থেকে ৫ ভাগ দারিদ্র্য আমরা বিমোচন করতে চাই। যাতে বাংলাদেশকে দরিদ্র বলে আর কেউ অবহেলা করতে না পারে, করুণা করতে না পারে।
তিনি বলেন, আমাদের যে নদী-নালা, খাল-বিল- বিশাল জলাধার আছে তার ওপর যে বিশাল সমুদ্রসীমা আমরা অর্জন করেছি। সেসব ব্যবহার করে দেশের জমিজমাকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষকে আমরা তো খাবার দিতে পারবোই বিশ্বের অনেক দেশকেও আমরা খাবার দিতে পারবো, সেই সক্ষমতাও আমরা অর্জন করতে পারি এবং সেজন্যই আমি সবসময় সমবায়কে গুরুত্ব দেই -যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সমগ্র বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ জায়গায় তাঁর সরকার ব্রডব্যান্ড দিতে সক্ষম হওয়ায় আজকাল অনলাইনেই কেনাকাটা হচ্ছে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মাহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে এর মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাজার খোঁজা, বাজার করা, নতুন পণ্য তৈরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করবে।
তিনি এ সময় সমবায়ের সাহায্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি সময়ের দাবি উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে এবং আমাদের আর্থ-সমাজিক আরো উন্নতি হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নের যে ধারাটা আজকে আমরা সৃষ্টি করেছি সেই ধারাটা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলবো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন আমরা পূরণ করবো। এটাই আমাদের লক্ষ্য।