ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বড় অংশই হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত। তবে বিতরণ করা ঋণের অনুপাতে অন্তত ১৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। এ তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি, বিশেষায়িত দুটি, বেসরকারি ৮টি ও বিদেশি খাতের দুটি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলোর ৮ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটির খেলাপি ঋণের ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ আদায় অযোগ্য মন্দঋণে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ মার্চ প্রান্তিকে অন্তত ৮টি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
সাধারণত ২ থেকে ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সহনীয় বলে ধরা হয়। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৫ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণকে সহনীয় বলা হয়। আর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে চলে গেলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের জন্য অ্যালার্মিং হিসেবে দেখা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে ঋণের সুদ ও আয়ের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ- এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৭টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সবমিলে গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। তিন মাস আগে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর ২০২২ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
অস্বাভাবিক খেলাপিঋণ দেড় ডজন ব্যাংকে : প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত মার্চে ১৬টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি, বিশেষায়িত ২টি, বেসরকারি ৭টি ও বিদেশি ১টি ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে আরও দুটি ব্যাংকের খেলাপিঋণের হার ৮ শতাংশের ওপরে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৮ দশমিক ৩৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৪৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ও সোনালী ব্যাংকের দেওয়া ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ ঋণ হয়ে পড়েছে খেলাপি। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সমস্যাকবলিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৮৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। ৪৩ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে আরেক সমস্যাকবলিত ব্যাংক বাংলাদেশ কমার্সের। এ ছাড়া এবি ব্যাংকের খেলাপিঋণ ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ, মেঘনা ব্যাংকের ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও উত্তরা ব্যাংকের ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯৮ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব ব্যাংকের খেলাপিঋণ ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ।
প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ৮টি : ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে প্রভিশন সংরক্ষণেও। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে সরকারি ও বেসরকারি মোট ৮টি ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তবে পুরো খাতে প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী গত মার্চে সর্বোচ্চ প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪ হাজার ১০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৮০ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৬০ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬০ কোটি ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এ ছাড়া যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।