রিজার্ভ-ডলারের সংকট, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী চাপসহ অর্থনীতির নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট প্রস্তাব ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য তিনি এ বাজেট উপস্থাপন করবেন। এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের এটা পঞ্চম বাজেট। একই সঙ্গে বর্তমান অর্থমন্ত্রীরও এটি পঞ্চম বাজেট।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেটের অর্থের জোগান পেতে সরকার আগের চেয়ে বেশি ব্যাংকমুখী। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারকে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, গত দেড় দশকে বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অর্জন একটি টেকসই গ্রাউন্ডওয়ার্ক বা ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ ৪টি মূল স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট ইকোনমি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
সূত্রমতে, এবারের বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২.৩৪ শতাংশ বেশি হবে।
এটি হবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার; যা প্রাক্কলিত জিডিপি’র ১৫.২১ শতাংশ। চলতি বাজেটের তুলনায় আসন্ন বাজেটের আকার বাড়ছে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরে এটি ছিল জিডিপি’র ১৫.২৭ শতাংশ। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণে অর্ধেকের বেশি পূরণ করা হবে ব্যাংকিং খাতের ঋণ নিয়ে।
ব্যয়ের বিপরীতে সরকার মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত জিডিপি’র ১০ শতাংশ। আর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এরমধ্যে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদান হিসেবে আসবে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে বাজেটে অনুদান ব্যতীত মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪.৩৬ শতাংশ এবং জিডিপি ৫.২ শতাংশ। ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এরমধ্যে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২ কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার এবং অন্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার, চলতি অর্থবছরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সরকার আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে যে টাকা ঋণ নেবে, তার অধিকাংশই হবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। এ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাবে। তাছাড়া ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। তাই ব্যাংক ঋণ না বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের অর্থের চাহিদা পূরণের তাগিদ দেন তিনি।
সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা স্থানীয় উৎস থেকে আসবে। বাকি ৯৪ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৫.৭৪ শতাংশ আসবে বিদেশি উৎস থেকে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের বরাদ্দ বিবেচনায়, আগামী অর্থবছরে সার্বিক আনুমানিক উন্নয়ন ব্যয় দাঁড়াবে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। প্রধান ব্যয়ের মধ্যে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় হিসাবে রাখা হবে। যার মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা সুদ পরিশোধে। ৮০ হাজার কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ব্যয় বহনের জন্য। ভর্তুকির জন্য ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধের জন্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।
অনুদান হিসেবে ৩ হাজার কোটি টাকার পাশাপাশি নিট বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা পাওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলেও আগামী অর্থবছর গড় মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ৯.২৪ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৬৪ শতাংশ।
এদিকে আগামী অর্থবছরে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ৮টি প্রধান চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; তেল, গ্যাস ও সারের বিপুল ভর্তুকি প্রদান, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলোকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেয়া মানেই হলো টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থান ব্যবস্থা।
অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে, যার প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপরে।
আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বেশির ভাগ আয়কর রিটার্ন জমাকারীকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেয়ার বাধ্যবাধকতা আসছে। কারণ, ৪৪ ধরনের সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে। যেমন সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড নেয়া, রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি দেয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ নেয়াসহ সাধারণ করদাতার নেয়া কিছু সেবা এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে। আগের ৩৮টি সেবার ওপর এ বছর আরও ৬টি সেবা যুক্ত হচ্ছে।
আবার মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় উন্নীত করার ঘোষণাও থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
আগামী বাজেটে এনবিআর বিভিন্ন খাতে উৎসে কর বসিয়ে কর আদায়ে বেশি মনোযোগী। জমি-ফ্ল্যাট কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হচ্ছে, উল্টো নিবন্ধন ফি বাড়তে পারে। ভ্রমণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব পাস হলে বিদেশ ভ্রমণে বাজেট বাড়াতে হবে।
মুঠোফোন, দামি গাড়ি, সিগারেট, কলম, প্লাস্টিকের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টিস্যু, ন্যাপকিন- এসবের ওপর বাড়তি শুল্ক-কর আরোপের প্রস্তাব করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এসব জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে। দাম কমতে পারে দেশি সফটওয়্যার, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটর, বাইসাইকেল ইত্যাদির।
এ বছর বাজেটে বড় চাপ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত। এগুলো ঋণ দেয়ার প্রথম বছরেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কর রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। কারণ, আইএমএফ-এর হিসাবে আগামী অর্থবছরে কর রাজস্ব বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া শর্ত অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা কম ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।
নির্বাচনী বছরে সর্বোচ্চ ১৪ মেগা প্রকল্পে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমন ১৪টি মেগা প্রকল্প ও কর্মসূচির জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৬৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৫৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। বাড়ছে প্রায় ১১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অধিবেশন ২৬শে জুন পর্যন্ত চলার পর ২রা জুলাই পর্যন্ত মুলতবি করা হবে। ২৬শে জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে। এবার কোরবানির ঈদের কারণে কিছুটা আগেভাগে পাস করা হবে। বাজেটের ওপর মোট ৪০ ঘণ্টা আলোচনা হবে। সংসদের বৈঠক প্রতিদিন বিকাল ৫টায় শুরু হবে।