নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনীতিকেরা। এসব দেশের রাজধানী ও সংস্থার প্রধান কার্যালয় থেকেও নজর রাখা হচ্ছে নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর। সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় চলছে বৈঠক।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মানবাধিকার, শ্রমের মান, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্যের বিষয়ভিত্তিক আলোচনার বাইরে প্রায় সব কটি বৈঠকে নির্বাচন-সম্পর্কিত বিষয় আসছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিএনপির মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ সমাধানের পথ খোঁজার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
চলতি বছর এ পর্যন্ত কূটনীতিকেরা কমপক্ষে ১৬টি বৈঠক করেছেন সরকার, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির সঙ্গে। এসব বৈঠকে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, জাপান, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ও ভারতের হাইকমিশনার।
রাজনৈতিক সংকট কাটাতে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ শুরু হওয়া দরকার। এ বিষয়ে দুই দলের অধিকাংশ নেতা কূটনীতিকদের সঙ্গে পৃথক আলোচনায় একমত পোষণ করেছেন বলে কয়েকটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। তবে সংলাপ কখন কোন শর্তে হতে পারে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত ভিন্ন মেরুতে আছে প্রধান দুই পক্ষ। তারপরও সংলাপ প্রসঙ্গে দুই দলের নেতারা এরই মধ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
দুই দিনে যত কথা হলো
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সবকিছু সংলাপের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে হবে। আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। …সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।’
তবে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে দল এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে গতকালই জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এর আগের দিন অবশ্য দলটির প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু সংলাপের বিষয়টি সামনে আনেন। ঢাকায় সমাবেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক আমু বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে দেখতে চাই, কোথায় সমস্যা, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায় এবং কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়। এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই সুরাহা হতে পারে, অন্য কোনো পথে নয়।’
আমুর ওই বক্তব্য প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের মত, দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট হয়নি যে জাতিসংঘের এখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা আমাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। প্রয়োজনে আমরা নিজেরাই সমাধান করব।’
গতকাল ছয় দফা দিবসের আলোচনা সভায় কাদের এসব মন্তব্য করেন। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমির হোসেন আমু। আগের দিনের বক্তব্য নিয়ে গতকাল অবশ্য তাঁর কণ্ঠে ছিল ভিন্ন সুর। তিনি বলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত না যে দাওয়াত করে এনে খাওয়াব। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয় নাই, কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয় নাই।’
লিখিত প্রস্তাব চায় বিএনপি
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিকে আমলে নিতে নারাজ বিএনপি নেতারা। তবে লিখিত কোনো প্রস্তাব এলে দল বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে বলে তাঁরা উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এসব বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেওয়ার জন্য ভাবব।’
দুই দলের ভিন্ন অবস্থান
সংলাপ প্রয়োজন, সে বিষয়ে কূটনীতিকেরা এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কমবেশি একমত হলেও সেই আলোচনায় কী আসবে, নির্বাচনকালীন সরকারে কে নেতৃত্ব দেবেন, শেখ হাসিনা নাকি অন্য কেউ, এসব বিষয়ে দুই দলের নেতাদের অবস্থান উল্টো মেরুতে।
আওয়ামী লীগ নেতারা এসব বৈঠকে সংবিধানিক ধারাবাহিকতার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলছেন। অন্যদিকে বিএনপি চায় প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।
সংলাপ শুরু হলেও তা ফলপ্রসূ হবে কি না, সে বিষয়েও সংশয় আছে দুই দলেই।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে বিএনপির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছিল। সেই বৈঠকের উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, আওয়ামী লীগ তখন যেসব অঙ্গীকার করেছিল, সেগুলো রক্ষা করেনি। এ কারণে আওয়ামী লীগের কথায় আস্থা রাখার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ পদত্যাগে নীতিগতভাবে রাজি হয়ে যদি নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ব্যাপারে কথা বলতে চায়, তাহলে বিএনপি বিবেচনা করবে বলে তিনি জানান।
অন্যদিকে বিএনপির নাম উল্লেখ করে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল বলেছেন, যারা নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়, নির্বাচন ঠেকাতে চায়, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ হবে, সেটি হচ্ছে বড় প্রশ্ন। সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ইইউ দূতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি গতকাল ঢাকায় নিজের দপ্তরে বৈঠক করেন বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। এ বৈঠকে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে তাঁরা আগামী নির্বাচন এবং সরকারের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার অধিকারগুলো লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলেন। সেখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির আলোচনার সম্ভাবনার বিষয়টিও ইইউ দূত তুলে ধরেছেন বলে একটি সূত্র জানায়।
মার্কিন দূতের সঙ্গে জ্বালানি উপদেষ্টার বৈঠক
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গতকাল বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সঙ্গে। উপদেষ্টার একান্ত সচিব মুকতাদির আজিজ এ বৈঠকটি হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক সম্পর্কে কোনো পক্ষ কিছুই প্রকাশ করেনি।