এক দফা আন্দোলন নিয়ে আগামী জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। গত শুক্রবার দলের স্থায়ী কমিটির এক ‘বিশেষ বৈঠকে’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মতামত জানতে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে বিএনপি।
এক দফা আন্দোলন কবে নাগাদ শুরু হবে, জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে এক দফার আন্দোলনে আমরা যাব। এ জন্য অপেক্ষা করুন। দ্রুতই দেখতে পাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই এক দফা আন্দোলনের কথা বলছি। আমরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলছি। এ দাবিগুলো চলমান যুপপৎ আন্দোলনের ঘোষিত ১০ দফার প্রথম দফা।’
গত শুক্রবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি ‘বিশেষ সভা’ হয়। রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক দফার যৌথ ঘোষণা দেওয়া হবে। সব দল কিংবা জোট আলাদাভাবে এক দফা ঘোষণা করবে। ঢাকায় বড় সমাবেশ বা জমায়েত করে এক দফা ঘোষণা করতে চায় বিএনপি। আন্দোলন এক দফার হলেও এর মধ্যে থাকবে- সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি। অভিন্ন এক দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে ১০ দফার বিলুপ্তি ঘটবে।
এক দফার যৌথ ঘোষণার পর থেকে লাগাতার আন্দোলনে যাবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। তবে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি দ্রুতই ঠিক হবে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। যুগপৎ আন্দোলনের সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে এক দফা ঘোষণার আগেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। তবে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হলেও বিভিন্ন ইস্যুতে দলীয় কর্মসূচিও অব্যাহত থাকবে।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে রাষ্ট্র মেরামতের যৌথ ঘোষণাপত্রও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এটিও ঘোষণা করা হবে, কিন্তু দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। তবে এক দফা ঘোষণার আগেই দিনক্ষণ ঠিক হতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর আন্দোলন করছি। এখন রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে কাজ চলছে। আমরা আশা করছি দ্রুতই চূড়ান্ত করা হবে।’
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আগামী ২১ জুন ঢাকায় একটি সেমিনার করবে বিএনপি। সেখানে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কেন প্রয়োজন, কোন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করা হয়, কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয় ইত্যাদি বিষয় সেমিনারে তুলে ধরা হবে।
শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে সমাবেশের মাধ্যমে ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। ১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় যুগপৎ আন্দোলন। ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত যুগপৎভাবে সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট নানা কর্মসূচি পালন করে। গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে গত ঈদের পর থেকে বিএনপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
এদিকে বিএনপির কর্মসূচির মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বড় শহরে ১১ দফার ভিত্তিতে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করছে দলটির প্রধান তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত এবং ওই তিন সংগঠনের সাংগঠনিক শক্তি পরখ করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বুধবার চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। আগামী ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে।
বিএনপির পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দল ও জোট কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। যুগপতের ধারায় দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি করছে তারা। গণতন্ত্র মঞ্চ গত ৪ জুন থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঢাকা থেকে দিনাজপুর অভিমুখে রোডমার্চ করেছে। এ ছাড়া লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের প্রতিবাদে আগামীকাল সোমবার বিক্ষোভ করবে।
যা যা থাকছে এক দফায়
সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা; বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি; মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার; ফরমায়েশি সাজা বাতিল; নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি এক দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এক দফার প্রথম ধাপে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিই থাকবে। হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কোনো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। তৃণমূল ও কেন্দ্রে ঘুরেফিরে আবারও গণসমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, পদযাত্রা, গণঅবস্থান, মানববন্ধন, গণমিছিলের মতো কর্মসূচি পালিত হবে। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন হবে ঢাকামুখী। সে ক্ষেত্রে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি আসবে। দলটির সেই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ‘স্বল্প সময়ের’ হবে বলে নেতারা জানান।
এদিকে রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণাপত্রও’ চূড়ান্ত হওয়ার পথে। বিএনপি প্রণীত ৩১ দফা এই ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ মোটা দাগে তিন দফায় আটকে ছিল। সেগুলো হলো- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার; দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি ও এমপিদের ক্ষমতা এবং নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম। পরে এটি নিয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও উভয়পক্ষ নিজ অবস্থানে অনড় থাকায় সংকট কাটেনি। এমন পেক্ষাপটে সংকট নিরসনে ‘প্ল্যান-বি’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ‘প্ল্যান-বি’ অনুযায়ী, শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য না হলে যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলো যার যার মতো করে রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণা’ করবে। অভিন্ন দাবিতে এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা করা হবে।
জানা গেছে, গণআন্দোলনের অভিন্ন একদফা চূড়ান্ত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ নিয়েও গণতন্ত্র মঞ্চ ও বিএনপির মধ্যে তেমন মতবিরোধ এখন নেই। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘রূপরেখা চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে শুধু শব্দগত কিছু হেরফের হবে। আশা করি দ্রুতই তা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের এক দফা ঘোষণার আগেই ‘রাষ্ট্র মেরামতের যৌথ রূপরেখা’ ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দেশি-বিদেশি সবাই শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছে। এর পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এখানে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বিএনপিকে।