কারসাজি করে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর নেপথ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিত্যপণ্য আমদানিকারক আটটি বড় প্রতিষ্ঠানের এই সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। রাজধানী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত সারা দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে চক্রটি। তাদের কাছে জিম্মি পুরো দেশ। তারা বেআইনিভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে প্রতি বছর হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এই সিন্ডিকেট লালনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত।
এ কারণে বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটি কার্যকর হচ্ছে না। ফলে ঐ অসাধু চক্র বিভিন্ন পণ্যকে টার্গেট করছে, বাড়াচ্ছে দাম। যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখন তা আমদানি করে বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। আর এই সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন ভোক্তারা। বাড়তি দরে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তবে এই সিন্ডিকেটের হাতিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ভাগ এদিক-সেদিক দিতে হয়।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে আটটি কোম্পানি ঐ সিন্ডিকেটে জড়িত তাদের নাম, সিন্ডিকেট লালন-পালনে জড়িত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নামগুলো সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করেছে। কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে সরানোর সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু তাদের সরানো হয়নি। মন্ত্রণালয়ের অসাধু ঐ সব কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেটে জড়িত আট কোম্পানি বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গেও জড়িত। ইতিমধ্যে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিন্ডিকেটটি চাল থেকে শুরু করে ডাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, শাক-সবজি, চিনি, মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজি করছে। এসব পণ্যের যখন চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, তখনো অসাধু ব্যবসায়ীদের ঐ সিন্ডিকেট অহেতুক দাম বাড়িয়ে দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেই বাড়তি দাম অব্যাহত থাকে। ঐ সময়ের মধ্যে ভোক্তার পকেট কেটে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। বছরের পর বছর এ অপকর্ম চললেও রহস্যজনক কারণে সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একরকম নির্বিকার। মাঠপর্যায়ে কয়েকজনকে নামমাত্র জরিমানা করে দায়সারা গোছের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন তারা। অধরা থেকে যায় সিন্ডিকেটের মূল নায়করা। ২০১৯ সালে ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জুলাই থেকে দেশে এই পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। আগস্টে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশে এ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম লাগামছাড়া হয়ে ওঠে। অক্টোবর পর্যন্ত দাম বাড়তে বাড়তে ৩০ টাকা কেজির পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়। ঐ সময়ে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কনসাস কনজ্যুমারস সোসাইটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিন্ডিকেট ভোক্তার পকেট থেকে তখন প্রায় ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এছাড়া প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে এবং জুলাই থেকে আগস্টে চালের দাম বাড়ানো হয়। চলতি বছরে চালের দাম বাড়িয়ে ১৩ মে থেকে ২৫ জুন এ ৪৯ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন চালের পাশাপাশি অসাধু ব্যক্তিরা আটার দামও বাড়াতে শুরু করেছে। এছাড়া প্রতি বছর রোজার মাসকে কেন্দ্র করে চিনি, ছোলা, শসা, বেগুনের দাম হয় আকাশচুম্বী। কোরবানির ঈদ ও শীতে বাড়ে মসলার দাম। এভাবে একটির পর একটি পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়ানো হয়। এভাবে প্রায় পুরো বছরই সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। জানা গেছে, ২০২০ সালে পণ্যমূল্য বাড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি তদন্ত করেছে।