পুব আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দিয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই ছোট্ট নদীর বুকে বিভিন্ন ধরনের পণ্যবোঝাই শত শত ডিঙি নৌকা এসে ভিড়ছে। গৃহস্থ পরিবারগুলো নৌকায় হাটে এসেছে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। নদীতে নোঙর করা আছে বড় ট্রলার। ডিঙি নৌকা থেকে দরদাম করে হরেক রকম সবজি কিনে ট্রলারে তুলছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ছোট নদীর মৃদু ঢেউয়ের তালে চলছে হাটের কেনাবেচা। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন এ দৃশ্য চোখে পড়বে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার লাগোয়া বেলুয়া নদীর ভাসমান হাটে। পিরোজপুর জেলা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের বেলুয়া নদীর তীরে বৈঠাকাটা বাজার। এই বাজারের পূর্ব পাশে বেলুয়া নদীতে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ভাসমান হাট বসে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, বেলুয়া নদীর আশপাশের ২০-২৫ গ্রামের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল, বিভিন্ন ধরনের চারা, ধান ও চাল কেনাবেচা করেন এই ভাসমান হাটে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনপদের সব মৌসুমি পণ্য সারা বছর কেনাবেচার কারণে সমৃদ্ধ হয়েছে বেলুয়া নদীর ভাসমান হাট। বৈঠাকাটা বাজারের ব্যবসায়ী মো. আবদুল গফুর মিয়া বলেন, নদী-খালবিল বেষ্টিত নাজিরপুর উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে একসময়ে সড়কপথে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। তখন নৌপথে নৌকায় করে চলাচল ও পণ্য পরিবহন করা হতো। শত বছর আগে স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য নৌকায় করে বেলুয়া নদীতে নিয়ে আসতেন। আবার ক্রেতারা নৌকা থেকে পণ্য কিনে নৌকায় করে নিয়ে চলে যেতেন। নৌকায় বসে চলত বিভিন্ন নিত্যপণ্যের কেনাবেচা। এভাবে বেলুয়া নদীতে ভাসমান হাটের শুরু। ধীরে ধীরে হাটের পরিধি বেড়েছে। কয়েক দশক ধরে এ হাটে দূরদূরান্ত থেকে ট্রলার নিয়ে আসছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা এখান থেকে কৃষিপণ্য ও শাকসবজির চারা কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে ভাসমান হাটের পশ্চিম পাশে বেলুয়া নদীর তীরে গড়ে ওঠে বৈঠাকাটা বাজার। বৈঠাকাটা বাজার ও বেলুয়া নদীর ভাসমান হাটকে ঘিরে এ অঞ্চলের কৃষিপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার লাভ করে। নাজিরপুর উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, মুগারঝোর, মনোহরপুর, পদ্মডুবি, বিলডমুরিয়া, সোনাপুর, গাওখালী, চাঁদকাঠি, সাচিয়া, লড়া, পেনাখালী; নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া, গগন, মলুহার, কাঁটাখালী, ইলুহার, জনতা; বরিশালের বানাড়িপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি, উমারেরপাড়, উদয়কাঠী, কদমবাড়ি, চৌমোহনাসহ আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ভাসমান হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। ভাসমান এই হাট থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে শহরে নিয়ে যান। এ হাটের কৃষিপণ্য মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
বেলুয়া নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যে বসা ভাসমান হাটে কৃষকরা তাদের ক্ষেতের মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, মিষ্টিআলু, লাউ, করলা, পটোল, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, পেঁপে, কচু, কচুর লতি, কাঁচকলা, তাল, পুঁইশাক, মরিচ, নারকেল, কাঁঠাল, আম নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া হাটে বিক্রির জন্য শাকসবজির চারাও রয়েছে। পাইকাররা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে বড় নৌকা ও ট্রলারে করে নিয়ে যাচ্ছেন। হাটে রয়েছে কয়েকটি ভাসমান চায়ের দোকান। ছোট নৌকায় ঘুরে ঘুরে চা-বিস্কুট বিক্রি করছেন চা বিক্রেতারা। নৌকায় মাইক লাগিয়ে মুখরোচক খাবার বিক্রি করছেন হকাররা। সবজির হাটের পাশেই রয়েছে নারকেলের হাট। এখানে বেলুয়া নদীর শাখা খালে রয়েছে চাল, ধান ও মুড়ির হাট। এ ছাড়া নদীর এক প্রান্তে বয়েছে মাছ ধরা চাঁইয়ের হাট।
ভাসমান এই হাটের সবজি বিক্রেতা কৃষক ওসমান গণি বলেন, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ভাসমান এই হাটে সবজি বিক্রি করি। সবজি নিয়ে আসার পর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। পাইকাররা এসে দরদাম করে সবজি কিনে নেন। এ হাটে পণ্যের ভালো দামও পাওয়া যায়। বেলুয়া নদীর হাটে একসময় কৃষকরা তাদের শাকসবজি ডিঙি নৌকায় করে নিয়ে আসতেন। আশপাশের গ্রামের মানুষ সেই পণ্য কিনে নৌকায় করে বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন এ হাটে শহর থেকে সবজি ব্যবসায়ীরা ট্রলার ও ট্রাক নিয়ে আসেন শাকসবজি ও কৃষিপণ্য কিনতে।