শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বাজারে গিয়ে পণ্য কিনতে না পেরে সীমিত আয়ের মানুষকে কাঁদতে দেখেছেন; বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সরকারকে বিপদে পড়বেন, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। সামনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দ্বারা বাজারের আরো একাধিক পণ্যের দাম বৃদ্ধির ভয়ংকর পরিস্থিতি আসছে বলে সতর্ক করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মতে, খুব শিগগিরই দাম বাড়তে পারে নিত্য পণ্য আটা-ময়দা, ডালসহ একাধিক পণ্যের। সিন্ডিকেট কয়েক দিনের জন্য হঠাৎ করে বাজার অস্থিতিশীল করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ফান্ডকে সমৃদ্ধ করবেন বলে জানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের নাটের গুরু কারা? সিন্ডিকেটের হাত সরকারের হাতের চেয়েও কি লম্বা? কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটি ব্যবসায়ী সম্মেলনে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা আবারো শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তারা জানিয়েছেন এ সরকার ক্ষমতায় থাকায় তারা ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘেœ করতে পারছেন। তারা এমন তোষামোদী বক্তৃতা করেছেন তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরাও লজ্জা পেয়েছেন। তাহলে কি এদের ভিতরেই সিন্ডিকেটের হোতারা লুকিয়ে রয়েছে? দেশের মানুষ ভোটের অধিকার ফিরে পেতে উদগ্রীব আর এই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মহানন্দে কবির সুমনের গান ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই, শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ গান গেয়ে ধন্যধন্য ফেলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নির্বাচনের অপ্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন। ভুক্তোভোগীদের প্রশ্ন মাঝে মাঝে সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে সে টাকা কোথায় যায়?
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বিশ্ব বাজারের কারণে যদি কোনো পণ্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে সে পণ্যের দাম বাড়ে ৮০-৯০ শতাংশ। প্রতিটা পণ্যেই রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট ফাঁকা করছে, অথচ কোনো প্রতিকার মিলছে না। এই বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে তারাই আবার একেক সময় এমন এমন কথা বলেন, যাতে ব্যবসায়ীদের সাহস আরও বেড়ে যাচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙার এখতিয়ার ভোক্তা অধিদফতরের নেই, ভোক্তা আইনেও এটা কাভার করে না। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকার আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশন। জানি না তারা কী করছে এ ব্যাপারে। তবে ভোক্তা অধিদফতর তার সামর্থ্য অনুযায়ী বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে।
প্রতি বছর রোজা, ঈদ, কোরবানির ঈদ এলেই বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য টের পাওয়া যায়। ব্যবসায়ী নেতারা মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব শুরুর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঘোষণা দেন, চাহিদার অতিরিক্ত পণ্যের মজুদ থাকায় কোনো পণ্যেরই দাম বাড়বে না। বাণিজ্যমন্ত্রীও তখন মানুষকে আশ্বাসের বাণী শোনান। তারপর বাজারে গিয়ে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা বোকা হতে শুরু করেন। একই চিত্রনাট্যের মঞ্চায়ন চলছে বছরের পর বছর। সাধারণ মানুষের কাছেও বিষয়টি নিয়তির মতো হয়ে গেছে। এতোদিন বাজারে সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানো উৎসবকেন্দ্রীক হলেও গত কিছুদিন ধরে সুযোগ পেলেই সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করে আবার আমদানির নাম করে বাজার অস্বাভাবিক করছে। এভাবেই ব্যবসার নামে লুটপাট করে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার সম্প্রতি নিত্যপণ্যের দামে অসহায় সাধারণ মানুষের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, নিত্যপণ্যের দামের কারণে বাজারে গিয়ে অনেককে কাঁদতে দেখেছেন তিনি। এর একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট বলেও উল্লেখ করেন তিনি। কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। প্রতিমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা যখন বাজারে যাই তখন দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের কিন্তু কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের এই অবস্থা বিরাজ করছে।
সূত্র মতে, চলতি বছরের মার্চে হঠাৎ করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে ব্রয়লার মুরগির বাজার। ওই সময়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি থেকে হঠাৎ প্রতিকেজি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় উঠে। ব্রয়লার মুরগির সিন্ডিকেট রাতে দাম বেধে দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারে এসএমএস করে দেয়। অতপর বিক্রেতারা সেই দামে বিক্রি করেন। আর মুরগির মূল্য বেধে দেয়া সিন্ডিকেট কোম্পানি হচ্ছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। এর অগে ডিম নিয়ে কারসাজি করে গত বছরের শেষ দিকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট। এমনকি এক দিনে এক ডজন ডিমের দাম ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। ওই সময়ে সংসদে সাবেক তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, সিন্ডিকেট করে ডিমের নামে ৯৩২ টাকা লুট করা হয়েছে। বাস্তবে এই অঙ্ক আরও বেশি ছিল। অবশ্য এর কিছুদিন আগে দেশে তেল নিয়েও একটি গ্রুপ কারসাজি করে কয়েক হাজার কোটি হাতিয়ে নেয়। বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে সয়াবিন তেলের। বছর দেড়েক আগেও এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১১০-১১৫ টাকা। অথচ সেই সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ২০৫ টাকাতেও ঠেকেছিল। যদিও বর্তমানে লিটারে ১০ টাকা কমিয়ে ১৯৯ থেকে ১৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে সয়াবিন তেলের। তবুও এই পণ্যের বাজারেও সিন্ডিকেট থেমে নেই। এই সিন্ডিকেটেও নেতৃত্ব দিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ভোজ্য তেল নিয়ে এখনো চলছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। নিত্য প্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দামে অস্থিরতার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজিকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটি তথ্য পেয়েছে আমদানিকারক সিন্ডিকেটের কাছে পুরো বাজার জিম্মি। ভোজ্য তেলের মতোই চিনির বাজার এখনও টালমাটাল। ভারতে যেখানে এক কেজি চিনির দাম ৩৮-৪০ টাকা, সেখানে বাংলাদেশে এক কেজি চিনি কিনতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। মাঝে তো এক কেজি চিনির দাম ১৫০ টাকাও হয়েছিল। এই পণ্যটিরও দাম বাড়ানো হয়েছে বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে।
এরআগে হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম সেঞ্চুরি হাকায়। অথচ ওই সময়ে কোনোভাবেই প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৪৫ টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ ছিল না। এমন মন্তব্যই করেছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কৃষিমন্ত্রীর এই মন্তব্যের কয়েক দিনের মধ্যেই গত ৪ জুন কারসাজি করে হঠাৎ করেই মাত্র একদিনের ব্যবধানে খুঁচরা বাজারে ২৫ টাকা বেড়ে সেঞ্চুরি হাকায় পেঁয়াজের দাম। ওই এক দিনেই সিন্ডিকেট করে গ্রাহকের পকেট থেকে ১৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেন ব্যবসায়ীরা।
শুধু ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও ভোজ্য তেল, চিনি, পেঁয়াজই নয়; বাজারে বিদ্যমান অসৎ সিন্ডিকেটের কারণে অধিকাংশ পণ্যেই অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাজার সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বরং দিন দিনে ভোগ্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটধারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির ধুয়া তুলে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে পণ্যমূল্য। কখনো ভোজ্য তেল, কখনো চিনি বা মুরগি-ডিম, কখনো পেঁয়াজের বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হচ্ছে অস্বাভাবিক। এভাবে ভোক্তার পকেট কেটে ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের এই কারসাজির বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তেলের দাম বাড়ার পর ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি সুযোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে অসহায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে না। তারপরও এই মন্ত্রণালয়ের ঘাড়েই দায়টা আসে। আসলেই বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের কারসাজির এই তথ্য জানেন না। কারণ এর সঙ্গে জড়িত বড় বড় রাঘব বোয়ালরা। জড়িত রয়েছেন সরকারের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও।
চাল, ডিম, চিনি, ডাল, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, আলু, ভোজ্য তেল, শিশুখাদ্য ও মাছ-গোশতের অস্বাভাবিক দামের পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি দায়ী বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অনেক নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা এসব খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। বাজেটের মধ্যে থাকতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাতেও খরচ কমানোর পরিকল্পনা করছেন তারা।
এদিকে সামনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দ্বারা বাজারের আরও একাধিক পণ্যের দামে ভয়ংকর পরিস্থিতি আসছে বলে সতর্ক করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মতে, খুব শিগগিরই দাম বাড়তে পারে নিত্য পণ্য আটা-ময়দা, ডালসহ একাধিক পণ্যের। সিন্ডিকেট কয়েকদিনের জন্য হঠাৎ করে বাজার অস্থিতিশীল করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ফান্ডকে সমৃদ্ধ করবেন বলে জানিয়েছে।
এদিকে একের পর এক পণ্যে এভাবে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা লুটলেও সিন্ডিকেট ভাঙতে দেখা যাচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতার কারণেই ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উদাসীনতাও কখনো কখনো বাজার সিন্ডিকেটের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে।
খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাই বিভিন্ন সময়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অসহায় বাণিজ্যমন্ত্রীর মতোই সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেছেন, কোনো কোনো ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী কখন-কীভাবে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে-সেগুলো আমরা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরছি। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় ভোজ্য তেল, চিনিসহ অনেক পণ্যের মূল্য হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে। সর্বশেষ দেখলাম পেঁয়াজ এবং চার্জার ফ্যানে। পেঁয়াজের বিষয়টি যদি বলি-তা হলে, যখন ৩০-৩৫ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ৪০ টাকা হলো তখনই আমি বলেছিলাম পেঁয়াজের আইপি (আমদানি অনুমতি) দেয়া হোক। সেটি সেই এক মাস আগের কথা। কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হচ্ছে পেঁয়াজের। তখনই যদি পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হতো তা হলে দাম ১০০ টাকায় ঠেকত না। অথচ আমদানির অনুমতি দেয়া হলো এক মাস পরে। তত দিনে যা হওয়ার তাই হলো-ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জনগণের পকেট খালি করল। এভাবে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করার সুযোগ করে দেয়া হলো।
এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙার এখতিয়ার ভোক্তা অধিদফতরের নেই, ভোক্তা আইনেও এটা কাভার করে না। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকার আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশন। জানি না তারা কী করছে এ ব্যাপারে। তবে ভোক্তা অধিদফতর তার সামর্থ্য অনুযায়ী বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে।
সূত্র মতে, পেঁয়াজের বাজারের সিন্ডিকেট এখনও তৎপর রয়েছে। কারণ যেভাবে লাফিয়ে বেড়েছিল পেঁয়াজের দাম সেভাবে এখন আর কমছে না। কয়েক দিনের অস্বাভাবিক গরমে চার্জার ফ্যান ব্যবসায়ীরা লুটপাটের মৌসুম পেয়ে যায়। একদিকে অস্বাভাবিক গরম, অন্যদিকে লোডশেডিং। তাই দেশের মানুষ চার্জার ফ্যান কিনতে ইলেকট্রনিকসের দোকানগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা ২ হাজার টাকা দামের ফ্যান ৬ হাজার টাকা আবার কোথাও ৮ হাজার টাকাতেও বিক্রি করেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বাজার তদারকিতে এর প্রমাণ মেলে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে যতটা না বেড়েছে, ভোজ্য তেল ও চিনির দাম সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। এই পণ্য দুটির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মূলত ৫-৬টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি কৌশল নেয়। এর মধ্যে অন্যতম কৌশল হচ্ছে-যখন তারা মনে করবে দাম বাড়াব, তার ঠিক ৭-১০ দিন আগে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয়। আবার মিলেও উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এভাবে বাজার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয় সয়াবিন তেল ও চিনির। কয়েকদিনেই বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়। সে প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, বিশ্ব বাজারের কারণে যদি কোনো পণ্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে সে পণ্যের দাম বাড়ে ৮০-৯০ শতাংশ। প্রতিটা পণ্যেই রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট ফাঁকা করছে, অথচ কোনো প্রতিকার মিলছে না। এই বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে তারাই আবার একেক সময় এমন এমন কথা বলেন, যাতে ব্যবসায়ীদের সাহস আরও বেড়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মনে করেন, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই, তবে কৌশলে মিলেমিশে দাম বাড়িয়ে কষ্ট দেয়া হচ্ছে ভোক্তাকে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে না, পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী এগুলো করছে। এদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের।
উল্লেখ্য, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট নেতিবাচক আর আতঙ্কের এক শব্দে পরিণত হয়েছে। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ শুধু বাজারে পণ্যের দামের কারসাজিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে সরকারও। তাই মিলছেনা কোন সদুত্তরও। একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোনো একটি র্নিদিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল করা, ইংরেজি ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির মানে অনেকটা এমনই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের আলাদা একটি গুরুত্ব আছে। একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে যখন কোনো উদ্যোগ, বিনিয়োগ বা লেনদেন সম্ভব হয় না, তখন অনেকে মিলে সেটি করলে তাকে সিন্ডিকেট হিসেবে অভিহিত করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক আর আতঙ্কের এক শব্দে পরিণত হয়েছে, যা দিয়ে তারা ব্যবসায়ীদের এক ধরনের মেকানিজমকে বোঝেন, যার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে ভোক্তাদের ঠকানোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সর্বত্রই এখন এই সিন্ডিকেটের দৌড়াত্ম্য চলছে।