ঋণ পরিশোধ করছেন না ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিরা। ২০ জনের কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকের প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন মাসে ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৭৬ কোটি টাকা। এক টাকাও আদায় করতে পারেনি ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন; কিন্তু তারা তা পরিশোধ করছেন না। বছরের পর বছর ব্যাংকের খাতায় ঋণখেলাপি হিসেবে তাদের নাম লিপিবদ্ধ থাকছে। নানা কৌশলে বছরের পর বছর ঋণ আদায় করছেন না। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে; কিন্তু আইনের দীর্ঘসূত্রিতায় তা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ঋণ আদায় করতে না পেরে তাদের নতুন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত মার্চ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এসব খেলাপি ঋণের মধ্যে ৫০ দশমিক ৮৬ শতাংশই আটকা রয়েছে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে। গত বছরের মার্চের তুলনায় ২০ জনের কাছে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০ জনের কাছে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পৌনে ৯ শতাংশ।
শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছে খেলাপি ঋণ বাড়লেও ঋণ আদায় বাড়ছে না, বরং কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মার্চে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে খেলাপি ঋণ বেড়েছে চার হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা শতকরা ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়লেও আদায় হচ্ছে না। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা, যা ২০ জনের খেলাপি ঋণের মাত্র শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকগুলোর আলোচ্য তিন মাসে আদায় হয়েছে সাড়ে ২৫ কোটি টাকা। আদায়ের হার শূন্য দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সরকারি ব্যাংকগুলোর একটি এমওইউ আছে। প্রতি বছরই তাদের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো সময়ই এ লক্ষ্যমাত্রা আদায় করা সম্ভব হয় না। কারণ শীর্ষ ঋণরেখলাপিদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী। তারা নানা কৌশলে বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপও নেয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুধু বলা হয়, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। সবধরনের আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু বছরের পর বছর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় কী ধরনের শক্ত পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নেয়া হচ্ছে না। আর এ কারণেই গত তিন মাসে শীর্ষ ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায় হয়েছে শূন্য দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
অপর দিকে গত তিন মাসে ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক এক টাকাও আদায় করতে পারেনি শীর্ষ ঋণখেলাপির কাছ থেকে। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় এক দিকে ব্যাংকগুলোর নতুন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, অপর দিকে ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করতেই আয়ের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।