চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আবারও সংলাপের পরামর্শ দিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘এই সংকট রাজপথে মীমাংসার বিষয় নয়। চায়ের টেবিলে বসেই সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।’ রাজনৈতিক দলের নেতারাও বলছেন, সংলাপে আপত্তি নেই। তবে তা হতে হবে শর্তসাপেক্ষ।
ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা বলছেন, সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজতে সংলাপ হতে পারে। অন্যদিকে বিরোধী জোটের নেতারা বলছেন, সংলাপ হতে পারে ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘মার্কিন দূতও বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে।’
আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন ইসির কর্তারা। সে হিসেবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হতে মাত্র তিন মাস বাকি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এখনও মুখোমুখি অবস্থানে। দু’পক্ষই আবার একের পর এক সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। দেশের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা একাধিক দেশ এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা বলেছি, ওনারাও বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ডায়ালগ প্রয়োজন। ডায়ালগ ছাড়া এ সংকটগুলো আসলে রাজপথে মীমাংসা করার বিষয় নয়। কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসা উচিত, একসঙ্গে চা পান করা উচিত। তারপর আলোচনা করে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা উচিত।’
নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন– এমন মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘যে সংকট বিরাজ করছে, তা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে আমাদের (ইসির) কাজের কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু সমস্যাগুলো যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান হয়, তাহলে আমাদের জন্য নির্বাচন আয়োজন অনেক কমফোর্টেবল হবে।’
সিইসির এমন অবস্থান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আওয়ামী লীগও সংলাপ চায়। অবশ্যই সংলাপ করতে হবে। তবে সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখেই সংলাপে যেতে হবে। কোনোভাবেই সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না। নির্বাচন কীভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করা যায়, সে ব্যাপারে সংলাপ হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আলোচনা গ্রহণযোগ্য হবে না।’
তাহলে সংকটের সমাধান কীভাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে ড. রাজ্জাক বলেন, ‘আগামী দিনের রাজনীতির গতিবিধিই বলে দেবে সমাধান কীভাবে আসবে। তবে বিএনপি যেভাবে রাজনীতির নামে রাজপথে সহিংস আচরণ করছে, কর্মীদের লেলিয়ে দিয়ে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করছে– এ পথে সমাধান আসবে না।’ তাঁর মতে, রাজপথেই সমস্যার সমাধান হবে– এমন বক্তব্য দিয়ে বিএনপি জাতির সামনে নিজেদের দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিয়েছে। তারা রাজপথে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রাজনীতির এ অনাচার থেকে বিএনপিকে সরে আসতে হবে।
সরকারবিরোধী জোটের নেতারাও বলছেন, সংলাপে তাদেরও আপত্তি নেই। তবে সেটা হতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে। সিইসির সংলাপের পরামর্শের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সংলাপ হতেই পারে। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় না, তা প্রতিদিনই প্রমাণ হচ্ছে। তাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যদি সংলাপের আয়োজন হয়, তাহলে হতে পারে। এটি হতে হলে অবশ্যই ক্ষমতাসীন সরকারকে সরে যেতে হবে।’
সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংবিধান অন্তরায় হতে পারে না। গতকাল ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি অতীতের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘সাংবিধানিক ও নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেয়ে সুষ্ঠু ভোট জরুরি। জনগণ যে নির্বাচনকে গ্রহণ করে, সেটিই বৈধ। ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচন হয়েছে অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে। কিন্তু সেই নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সাংবিধানিক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন জনগণ গ্রহণ করেছিল।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাপার এ নেতা আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন সরকার সমর্থকরা। জনগণ ভোট দিতে পারেনি, বাকিগুলোতে র্যাব ও পুলিশ ভোট দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন আইনের চোখে বৈধ; কিন্তু এটিকে জনগণের সরকার বলা যায় না। ২০১৮ সালের নির্বাচনও আইনের চোখে বৈধ; কিন্তু জনগণের চোখে বৈধতা পায়নি। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন জনগণের বিচারে বৈধতা পাচ্ছে না।’
তবে জি এম কাদেরের এ যুক্তি নাকচ করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। সুষ্ঠু নির্বাচন নাকি সংবিধান রক্ষা– কোনটি গুরুত্বপূর্ণ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। সংবিধানের বাইরে নির্বাচন হয় না।’ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘তখন বিশেষ পরিস্থিতিতে একটা গণঅভ্যুত্থানের পর নির্বাচন হয়েছিল। তখন সামরিক শাসন থেকে দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। সেই পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়।’ বর্তমান রাজনীতির সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, “সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের কোনো পথ আপাতত নেই। ‘সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে’– এ শর্ত দিয়ে সংলাপ হবে না। সংলাপ হতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। সেটা হতে হবে সংবিধান মেনে।”
বিরোধী দলের দাবি, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়; তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব– এমন প্রশ্নে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘সংবিধানকে অক্ষুণ্ন রেখেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ খুঁজতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
সিইসির সঙ্গে মার্কিন দূতের সাক্ষাৎ
গতকাল বেলা ১১টায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্বাচন ভবনে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ সময় সিইসির সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান ও নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের জানান, মার্কিন দূতের সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভোটের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের মোটরসাইকেল অনুমতির বিষয়টি ইসির বিবেচনায় রয়েছে বলেও মার্কিন দূতকে জানানো হয়েছে। সিইসি বলেন, নির্বাচনে স্বচ্ছতার জন্য মিডিয়া ও পর্যবেক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন। পিটার হাস জানতে চেয়েছিলেন, গণমাধ্যমকর্মীরা মোটরসাইকেল ব্যবহারের অনুমতি পাবেন কিনা? জবাবে বলা হয়েছে, বিষয়টি ইসির বিবেচনায় রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে রিটার্নিং অফিসাররা অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মোটরসাইকেলের অনুমতি দেবেন।
পিটার হাস আরপিও সংশোধনের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন উল্লেখ করে সিইসি বলেন, আরপিও সংশোধনে কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার কথা তিনি শুনেছেন। কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানানো হয়েছে, কীভাবে ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
সিইসি বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিষয়েও মার্কিন দূত জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, নিবন্ধন পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, সেগুলো কমিশন কঠোরভাবে অনুসরণ করেছে। এ জন্য অনেক দল নিবন্ধন পায়নি।’
সিইসি জানান, কমিশন প্রত্যাশা করে, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিছু বিষয় নিয়ে প্রকটভাবে সংকট রয়েছে। সেগুলো যে কোনো মূল্যে সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘একটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক, যে পরিবেশে আগামী নির্বাচনটা হবে।’
অক্টোবরে আসছে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল
আগামী অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গতকাল সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। পিটার হাস বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সিইসিকে জানিয়েছি, অক্টোবরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রি-অ্যাসেসমেন্ট বা প্রি-ইলেকশন মনিটরিং টিম পাঠাবে। এ বিশেষজ্ঞ টিমে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা থাকবেন, যাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতি নিয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে।’
সিইসির সঙ্গে বৈঠকে আরপিওর সর্বশেষ সংশোধন, নতুন দল নিবন্ধনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় কূটনীতিকদের বিবৃতিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন– এ বিষয়ে পিটার হাসের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ যখন রাজনৈতিক বিষয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বক্তব্য শোনে এবং তা ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন হিসেবে নেওয়া হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শুধু অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আগ্রহী। বাংলাদেশের জনগণ সরকার বেছে নেওয়ার ক্ষমতা রাখবে– এমন নির্বাচনেই যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী।’