নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অগ্নিমূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করতে না পেরে মধ্যবিত্ত মানুষও এখন লাজলজ্জা ভুলে সামান্য কিছুটা কম দামে চাল, ডাল, তেল কিনতে টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বর মহামারির রূপ নিয়েছে।
হাসপাতালে শয্যা সংকটে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ব্যস্ত সড়কে তীব্র যানজটের ভোগান্তি শহরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অহরহ হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হলেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিক নানা সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে মন্দা দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদন ঘাটতির কারণে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।
অথচ জনজীবনের এসব সমস্যা পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে রাজপথ উত্তপ্ত করে রেখেছে। ফলে আন্দোলন কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মীদের ঢল নামলেও এতে সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে। সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলসহ সাম্প্রতিক সব কর্মসূচিতেই এ চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে পাত্তা না দিয়ে শুধু দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে। নেতাদের বক্তৃতায় প্রতিপক্ষের ইমেজ ক্ষুণ্ন করার প্রতিযোগিতা চলছে। যে কোনো সংকটের সমাধানের পথ না খুঁজে তারা ব্লেইম গেমে মেতেছে। রাজপথে লাখো নেতাকর্মী জড়ো করে পাল্টাপাল্টি শোডাউন দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে।
যদিও সরকারবিরোধী কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কিছু কিছু তাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দু’একটি ইস্যুকে সামনে এনে দলীয় ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে। গত জুন মাসে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে রোডমার্চ ও মিছিলসহ বেশকিছু কর্মসূচি দিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদে পদযাত্রা কর্মসূচি ডেকেছে। তবে তাদের এসব আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদেরই জোরালো ভূমিকা না থাকায় সাধারণ জনগণ এতে আকৃষ্ট হয়নি।
এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এবং উপজেলা পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যে পর্যাপ্ত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রির দাবিতে সারা দেশে ১১ দিনের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। তবে এ আন্দোলনও হালে পানি পায়নি। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ওই কর্মসূচিতেও সাধারণ মানুষ সাড়া দেয়নি। অথচ সরকারবিরোধী এই প্রধান দলটি প্রায় সপ্তাতেই দলীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একাধিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও রাজপথ দখলে রাখতে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে। তাদের আন্দোলনেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই।
সরেজমিন ক্ষমতাসীন দল ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সভা-সমাবেশ, মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের সিংহভাগই ভাড়াটে। নগদ টাকা কিংবা খাবারের প্যাকেট দেওয়ার চুক্তিতে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আনা হয়েছে। একই ব্যক্তির বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ারও অসংখ্য নজির রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন- সবকিছু জনগণের কল্যাণের জন্য। অথচ জনগণের অভাব-অভিযোগ, অধিকার যদি রাজনীতিতে উপেক্ষিত থাকে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি তা আমলে না নেয়, তাহলে সেই রাজনীতির প্রয়োজন কোথায়? তাদের ভাষ্য, কেবল সরকারি দলের নেতারাই যে জনজীবনের সমস্যা ও সংকট নিয়ে উদাসীন তা নয়। বিরোধী দলের নেতারাও এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চান না। তারা মনে করেন, ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তারাও বিরোধী দলে থাকতে একই মনোভাব পোষণ করতেন। আসলে জনগণের সমস্যা-সংকট নিয়ে কোনো দলই উদ্বিগ্ন নয়। কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা যাবে, সেটাই তাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনস্বার্থ উপেক্ষিত চলমান রাজনীতি দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি উপহাস ছাড়া কিছু নয় বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে রাজনীতির মাঠে বর্তমানে বিএনপির ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং বিপরীতমুখী বক্তব্য-বিবৃতিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলেও তা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট রাজনীতি নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে এ আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। যদিও দলটি একেবারের ‘জনবিচ্ছিন্ন’ বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে দাবি তুলেছে, তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগ যেভাবে মাঠে নেমেছে তাতে এটা মনে হয় যে বিএনপির ‘জনসম্পৃক্ততা’ ধীরে ধীরে বাড়ছে। দলটি দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে সংগঠন গুছিয়ে এখন জনসম্পৃক্ততার দিকে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক, যে রাজনীতিটাকে তারা সুসংহত করছে- বলেন অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী। কিন্তু দাবি আদায়ে বিএনপির চলমান কর্মসূচি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান। তিনি মনে করেন, এ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে বাধ্য করা খুব কঠিন। কেননা ক্ষমতাসীন সরকার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। দ্বিতীয়ত সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো নেই। আর তৃতীয়ত হলো, বিএনপি যে পর্যায়ে মুভমেন্ট করছে এ রকম মুভমেন্ট দিয়ে সরকার পতন ঘটানো কিংবা ওই ধরনের দাবি আদায় করা কঠিন।
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপিকে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যেখানে জনসম্পৃক্ততা বেশি। কিন্তু আমার মনে হয় জনগণের একটা বড় অংশ এই ধারাবাহিকতাকে এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পক্ষেও কথা বলছে’- যোগ করেন অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী।
এদিকে শুধু মাঠের রাজনীতিতেই নয়, নানা গ্যাঁড়াকলে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। যার নেপথ্যেও রাজনৈতিক মদদ ও ইন্ধন রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পর্যালোচনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানা প্রকার অনিয়ম অসঙ্গতি আদালতের নজরে এনে নিয়মিতই জনস্বার্থে মামলা হচ্ছে। এতে মামলার তালিকা দীর্ঘ হলেও খুব সামান্যেরই প্রতিকার মিলছে। দ্রুত সময়ে প্রতিকার পেতে সংক্ষুব্ধদের বড় অংশই ঝুঁকছে রিট মামলার দিকে। আদালতও মামলাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে রুল ও আদেশ দিচ্ছেন। বিপত্তি বাধছে, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ এ সংক্রান্ত হাজার হাজার মামলায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা রায় দিলেও তা বাস্তবায়নের হার খুবই কম। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়তই উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে, যা মূলত রাজনৈতিক কারণেই ঘটছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা জানান, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তামিল করা সম্ভব হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া তথ্য মতে, পানিতে দূষণ, পরিবেশ দূষণ, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, নদী দখল ও দূষণ রোধ, খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ঠেকানো এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে জনস্বার্থে একের পর এক মামলা হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু সংগঠন এ ধরনের মামলা করছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবী ব্যক্তিগতভাবেও এ ধরনের মামলা করে থাকেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে যে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না তার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে।
২০০১ সালে ঢাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করতে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। অথচ দীর্ঘ ২২ বছর পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দখলদারদের দৌরাত্ম্যে অধিকাংশ ফুটপাতই হাঁটার অনুপযুক্ত। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ফুটপাতগুলো দখল করে অবাধে ব্যবসা চালাচ্ছেন। অথচ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ীও রাস্তায় বা জনগণের চলাচলের জায়গায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিপন্ন চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নদী খনন ও পলি অপসারণ এবং নদীর তীরে গাছ লাগানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে ওই রায়ের পর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। এতদিনেও রায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছর আগে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু ২০১২ সালের এই রায় এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
যানজট ও ধুলাবালির এই ঢাকা শহরে গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণ ও পরিবহণের সময় পথচারীরা দুর্ভোগে পড়েন। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৮ নির্দেশনা দেন। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি।