জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যয়ের ক্ষেত্রে ৩৭ কোটি ২৭ লাখ টাকার গরমিল পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের দুই অর্থবছরের আর্থিক নিরীক্ষায় এ গরমিল পাওয়া যায়। এ নিয়ে ব্যাখ্যা চাইলেও প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য সন্তোষজনক নয়। এই টাকা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা করার পাশাপাশি অনিয়মে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষা দলের প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়। সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করে সমীক্ষা দল। দুই অর্থবছরে মোট চারটি অডিট আপত্তি উঠেছে। গরমিলের অভিযোগে সরকারি কোষাগারে ৩৭ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ টাকা আদায় করার কথা বলা হয়েছে।
অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। তিন বছর অতিবাহিত হলেও প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪৪ শতাংশ। একে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে সাতটি অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে– সরকারি ক্রয় বিধিমালা অমান্য করে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি নলকূপ স্থাপন, বাজার দরের চেয়ে বেশি ব্যয়ে সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন, জলাধার স্থাপন ও কাজে ব্যর্থ ঠিকাদারের জামানত বাজেয়াপ্ত না করে উল্টো আরও সুবিধা প্রদান করা, কাজের জায়গা নির্ধারণ না করেই ঠিকাদারের সঙ্গে কাজের চুক্তি সম্পাদন এবং নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে জলাধার নির্মাণ করা।
অডিটের প্রথম আপত্তিতে বলা হয়, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) উপেক্ষা করে প্রকল্পের সংশোধিত প্রাক্কলন অনুমোদন ও বিল পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩ টাকা। এ বিষয়ে নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ‘বাস্তবতার স্বার্থে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রাক্কলন অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।’ তবে নিরীক্ষক বলেছেন, জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ বাস্তবতার নিরিখে ভেরিয়েশন অনুমোদন করা হয়েছে বলা হলেও কোনো নিয়মনীতি না মেনে এবং ঠিকাদারের কোনো আবেদন না থাকা সত্ত্বেও যাচাই-বাছাই ছাড়া সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে। আপত্তি করা অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
অডিটের পরের আপত্তিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পে নলকূপ স্থাপনের যে চাহিদা দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি স্থাপন করায় সরকারের অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬২ টাকা। এর জবাবে প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, বরাদ্দ সাপেক্ষে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে এই জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয় বলে অডিটর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। জবাবে নিরীক্ষা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ প্রকল্প প্রস্তাবে বরাদ্দ থাকলে নির্বাহী প্রকৌশলীরা প্রকল্প পরিচালকের কাছে চাহিদা দিয়ে থাকেন; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে সাবমারসিবল পাম্পযুক্ত গভীর নলকূপের বরাদ্দ না থাকলেও অনিয়মের মাধ্যমে সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
তিন নম্বর অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, বাজার মূল্য যাচাই করে প্রকল্প প্রস্তাবে সাবমারসিবল পাম্প ও জলাধারসহ অগভীর নলকূপ স্থাপনে যত টাকা ব্যয় ধরেছিল, তার চেয়ে বেশি মূল্যে এসব কাজ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪ টাকা। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর জানায়, ডিপিপিতে নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে চুক্তি করা হয়নি। প্রমাণসহ বিস্তারিত জবাব পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। এর প্রতিউত্তরে নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিবেদনে বলেছে, জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। প্রমাণ যাচাই করে আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে এবং ডিপিপির অতিরিক্ত মূল্যে প্রাক্কলন ও কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে।
অডিটের চার নম্বর আপত্তিতে বলা হয়েছে, কাজ করতে ব্যর্থ হওয়া ঠিকাদারের জামানত বাজেয়াপ্ত করে সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৭৫ লাখ ৯৬ হাজার ১৯৭ টাকা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর অডিট আপত্তির জবাবে জানিয়েছে, সরকারি নির্দেশনায় করোনাকালীন শিল্পকারখানা ও মালপত্র পরিবহন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় নলকূপ স্থাপনের মালপত্র সরবরাহ না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে ইতোমধ্যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে, এর ফলে সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি। জবাবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্যাদেশ দেওয়ার পরও ছয় থেকে আট মাস অতিবাহিত হয়েছে। সরকারি আদেশে কলকারখানা এত দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল না। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ে কাজ শুরু না করায় ঠিকাদারের চুক্তি বাতিল করা উচিত ছিল।
তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘অডিটে আপত্তি তুললেই অনিয়ম হয়েছে, এটা বলা যায় না। আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। তাতেও যদি আপত্তি নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে মন্ত্রণালয়, প্রকল্প পরিচালক ও অডিট বিভাগের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নথিপত্র প্রদান করার পর আপত্তিগুলো চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়। এই বৈঠকের পরও আপত্তি অমীমাংসিত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অডিট আপত্তির বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদবলেন, ‘অডিট বিভাগ থেকে প্রতি বছরই বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। পরে কিছু বিষয় নিষ্পত্তি হয়, আর কিছু আপত্তি শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। যে আপত্তিগুলো শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হয়, সেগুলোর বিষয়ে বিধি অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এটিই নিয়ম এবং এভাবেই হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে বিধির বাইরে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি না হয়। এমনটি হলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’