নির্বাচনি কূটনীতি: এবার বিদেশিদের ভিন্ন রকম তৎপরতা

নির্বাচনি কূটনীতি: এবার বিদেশিদের ভিন্ন রকম তৎপরতা

দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা বেড়ে চলছে, যা আগের যেকোনো নির্বাচনের সময়ের তুলনায় ভিন্ন রকম।

এবারের নির্বাচনে ভূ-রাজনীতির হিসাব বাড়তি গুরুত্ব যোগ করেছে। আগামী নির্বাচন বিষয়ে সর্বশেষ গত ৩ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক, একই দিন ভোট নিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতের মন্তব্য এবং পরদিন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার বিবৃতি নিয়ে সর্বত্র আলোচনার ঝড় বইছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোট নিয়ে বিদেশিরা এখনও আগের অবস্থানেই আছেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সামনে তাদের তৎপরতা আরও বাড়বে।

ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতি, সামাজিকসহ সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন করার পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব যোগ করেছে। এ সময়ের বৈশ্বিক ২ দশমিক ০ ঠান্ডা লড়াইয়ে বড় ক্ষমতার সব দেশই কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে কাছে পেতে চায়। এ কারণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরবসহ একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় তারা প্রকাশ্যে নির্বাচন নিয়ে কিছু বলছে না। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের সম্পর্কে দীর্ঘদিন টানাপড়েন চলায় তারা র‌্যাবের ওপর নিষেধ্বাজ্ঞাসহ বাংলাদেশ নিয়ে ভিসানীতি প্রকাশ করেছে। আমেরিকার সঙ্গে ব্রিটেন, কানাডাসহ ইউরোপের দেশগুলোও আগামী নির্বাচন নিয়ে বুঝতে চাচ্ছে। এ কারণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো প্রতিনিয়ত নির্বাচন বিষয়ে সরকারি এবং বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে।

সর্বশেষ গত ৩ আগস্ট নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদেরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেও তিনি নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পুনর্ব্যক্ত করেন। একই দিন ভোট নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুখপাত্র নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা বাংলাদেশের পরিকল্পনা অনুযায়ীই হবে। এ ঘটনার পরদিন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা আগামী নির্বাচন নিয়ে বিবৃতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সব রাজনৈতিক দল, তাদের সমর্থক এবং নিরপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর দলটির সমাবেশে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত কী বলল, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমাদের দরকার বাংলাদেশের মানুষ কী বলে? সেটাই আসল।’

ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে মনে হচ্ছে, তারা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশিদের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছেন না। বিশেষ করে বিদেশিরা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে কথা না বলায় বিরোধী দল হতাশ হয়ে থাকতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, যা নিয়ে বিদেশিরা কথা বলতে পারে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা বিদেশিরা আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশা একাধিকবার স্পষ্ট করেছে, যেখান থেকে তাদের অবস্থানের এখনও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিদেশিদের কী সমাঝোতা হচ্ছে তা আমরা বাইরে থেকে কিছুই জানি না। তবে সাধারণত মুখে যেসব কথাবার্তা উচ্চারণ হয় সেগুলো যে সব আমলে নেওয়ার মতো না তা আমরা জানি।

তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচন ইস্যুতে ভারত যেদিকে যাবে যুক্তরাষ্ট্রও সেদিকে যাবে বলে অনেকে বললেও আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ নির্বাচন নিয়ে ভারত কী চায় তা যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই জানে। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই, ভারত স্বাভাবিকভাবেই চাইবে এখানে নির্বাচন যাই হোক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারত খুশি হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। ভারতের জন্য বিএনপির ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। আর তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি দেশে নেই। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত ম্যানিপুলেট করবে নাকি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ম্যানিপুলেট করবে তা আমরা জানি না। আবার ভারত যেদিকে যাবে সেদিকেই যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লা ভারী হবে, এমন হলে তো যুক্তরাষ্ট্রের এত হইচইয়ের প্রয়োজন হতো না।

একসময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়টা ভারতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গত ২-৩ বছরে যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে অবস্থান একটু পরিবর্তন করেছে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন অনেক দিন ধরেই চলছে, যেখানে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

আবার নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানেরও কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বিষয়টা হচ্ছে-তত্ত্বাবধায়ক চাই, সবাইকে অবাধ সুযোগ দিতে হবে, কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না ইত্যাদি। এতে কথা বলার দরকার নেই। বিষয়টা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন নাকি আগের মতো বাজে নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই ১৪ বা ১৮ সালের মতো নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং যাকে দেবে সেই জিতবে। কেউ যদি এটা (যুক্তরাষ্ট্র) একশব্দে বলে সেটা গুড এনাফ। বিদেশিরা এটাই বলছে। এখন কে কী মিন করে বলছে তা আমরা জানি না। ওবায়দুল কাদেরও বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে। কিন্তু তার কথায় যদি সবাই আস্থা রাখতে পারত তা হলে কোনো সমস্যা থাকত না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ  বলেন, আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ এবারই প্রথম নয়। আগে থেকেই তাদের আগ্রহ রয়েছে। এবার হয়তো তা বেড়েছে। একসময়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশিরা সিভিল সোসাইটির বাসায় যেত, সকালের নাস্তায় যোগ দিত, টুয়েজডে ক্লাবসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড করেছে। এবার হয়তো আরও আগে থেকে বিদেশিরা তৎপরতা শুরু করেছে, সেটা হতে পারে। অনেক দেশ আগে এই বিষয়ে উৎসাহ না দেখালেও এবার উৎসাহ দেখাচ্ছে।

এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে-আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন, যেখানে বিদেশিরা সুযোগ পেয়ে যায়। যারাই বিরোধী দলে থাকে তারা বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। এতে সরকারি দলও বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়। আবার আমাদের গণতন্ত্রেও কিছু দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে গত দুই নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা আছে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এবার বিদেশিদের তৎপরতার পেছনে তৃতীয় যে বিষয়টি যোগ হয়েছে সেটা হচ্ছে ভূ-রাজনীতি। পশ্চিমা দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই চায় বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে থাকুক। আবার বিদেশিরা বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তারা আমাদের সঙ্গে অংশীদারত্ব বাড়াতে চায়, সেই জায়গায় বিদেশিরা একটা টেনশনে ভোগেন। কারণ বাংলাদেশ এখন বোঝে, শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই নয় বিশ্বের আরও রাষ্ট্র রয়েছে যারা বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়েছে।

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আরও বলেন, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান বা সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে পশ্চিমা দেশেরও চিন্তা থাকে যে বাংলাদেশ অন্য মেরুর প্রতি ঝুঁকে পড়ছে কি না। আর বিদেশিদের তৎপরতায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও বেশি জটিলতার মধ্যে পরে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সবসময়েই এ দেশের মানুষ ঠিক করেছে। বিদেশিদের তৎপরতার কারণে এ দেশের গণতন্ত্র ঠিক হয়েছে, এমন নজির কিন্তু নেই। বরং বিদেশিদের তৎপরতা বিভাজন আরও বাড়ায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান  বলেন, সরকার সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে নির্বাচনের সময়টায়। এ কারণে যাদের (বিদেশি কূটনীতিক) সরকারের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে হয় তারা নির্বাচনের সমটাকে বেশি কমফরটেবল মনে করে। সরকারের সঙ্গে বিদেশিদের এসব নেগোশিয়শনের সবকিছু প্রকাশ্যে হয় না। এ কারণে আমরা অনেক সময়ই অনেক কিছু বুঝি না। কিন্তু পর্দার আড়ালে অন্যান্য ইস্যু যেগুলো ডে টু ডে সরকার এসব শক্তি বা পক্ষের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে সেগুলোই ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে।

সাবেক এ রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, বিরোধী দল মনে করছে, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে। এ কারণে ইউএস এম্বেসি বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করে না করে এটা তারা (বিরোধী দল) একটু কাছ থেকে মনিটরিং করে। তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও হতাশা সবকিছু পশ্চিমাদের আচার-আচরণের ওপর নির্ভর করে। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ভারতের কমফোর্টের বাইরে কিছু করবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র এখনও অপেক্ষা করবে, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যেভাবে বিকশিত হয় বা যে দিকে যায় তার ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

সাবেক সচিব এবং ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার এএইচ মোফাজ্জল করিম  বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বা তৎপরতা এবার অতীতের চেয়ে ভিন্ন রকম। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ বা কোনো নজর দেয়নি। কিন্তু এবার তারা প্রচুর সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বন্ধু দেশ হিসেবে তাদের পরামর্শ দিতেই পারে; কিন্তু তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ সমস্যা বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশকেই সমাধান করতে হবে। বিদেশিদের আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের নিয়ম মেনেই কথা বলতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এবার দ্বাদশ নির্বাচনের আগে তারা এত সক্রিয় হলো কেন? আমার মনে হয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক খাতে যে উন্নয়ন করেছে তাতে আমরা এখন একটি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি। আমাদের অগ্রগতি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সেখানে বিদেশিরা হয়তো ভাবছে রাজনীতির ক্ষেত্রেও সমানভাবে পরিপক্বতা লাভ করা উচিত। বিদেশিদের মতামত প্রণিধানযোগ্য কিন্তু তাদের কিছুতেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।

সাবেক এই হাইকমিশনার আরও বলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদেশিদের সম্পর্কে সর্বশেষ যা বলেছেন অর্থাৎ বিদেশিদের মতামতে কিছুই যায় আসে না-এ বিষয়ে আমি মনে করি, তিনি মোটামোটি নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন। বিদেশিদের যে মতামত, তারা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন

জাতীয় রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ