বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি অধরাই পলাতক ঘাতকদের তথ্য দিলে পুরস্কার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি অধরাই পলাতক ঘাতকদের তথ্য দিলে পুরস্কার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক পাঁচ খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো অগ্রগতি নেই। ছয় খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিদেশে পালিয়ে থাকা পাঁচজনকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে তিনজন কোথায় আছেন সে বিষয়েও সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনজন পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করায় দেখা দিয়েছে জটিলতা।

বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার দাবি সরকারের। আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনির মধ্যে এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ও নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে সরকারের কাছে। তাদের ফেরাতে বারবার দুই দেশকে অনুরোধ জানানো হলেও আইনি জটিলতার কথা বলে ফেরত দিচ্ছে না মার্কিন ও কানাডার সরকার। ফেরানোর ব্যাপারে নিশ্চুপ যুক্তরাষ্ট্র।

ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বলছে, পলাতক খুনিদের আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের সবার নামেই ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি আছে। ইতোমধ্যে রেড নোটিশের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, দুইজন ছাড়া বাকি তিনজন কোন দেশে অবস্থান করছে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিদেশে আত্মগোপনে থাকা পাঁচ খুনি হচ্ছে- লে. কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী (বরখাস্ত), লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (বরখাস্ত), লে. কর্নেল আবদুর রশিদ (বরখাস্ত) ও রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেহ উদ্দিন। তিনজনের অবস্থান পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন এমন সংবাদ বের হলেও তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয়জনের এখন পর্যন্ত ফাঁসি হয়েছে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। সেসময় পলাতক ছিলেন ছয়জন। ১০ বছর পর ২০২০ সালে ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতকদের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলের রায়ে তিনজন খালাস পান। বাকি ১২ জনের মধ্যে ঘাতক আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর বের হয়।

পলাতক ৫ খুনিকে কোথায়: বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাকিস্তান, লিবিয়াসহ আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারবার অবস্থান বদল করেছে খুনিরা। কানাডায় অবস্থানকারী নূর চৌধুরী দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছেন দেশটির আদালত। এ ব্যাপারে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র–ডোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কোনো আসামিকে হস্তান্তর করা কানাডার আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। এ কারণে আইনি জটিলতায় আটকে আছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা। ২০০৪ সালে খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন দেশটির আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে ওই আদেশ ঝুলে থাকায় সে কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনতে ২০১৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। সংস্থাটি এ বিষয়ে মর্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ২০১৬ সালে মার্কিন আইন দপ্তরে চিঠি পাঠান। স্কাডেন এলএলপি ২০১৭ সালে জানায়, ঘাতক রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। পরবর্তী নানা আইনি অজুহাত দেখিয়ে ঘাতককে ফেরত পাঠাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

তিন খুনির অবস্থান নিশ্চিত নয়: বঙ্গবন্ধু দুই খুনি শরিফুল হক ডালিম ও আবদুর রশিদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া, সেনেগালসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করলেও তারা স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাস করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর দেয়নি তারা। এদিকে পলাতক খুনিদের আরেকজন মোসলেহ উদ্দিন ভারতে অবস্থান করছে একাধিক তথ্য বের হলেও পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর আগে তার জার্মানিতে অবস্থানের তথ্যও ছিল গোয়েন্দাদের কাছে।

আইনমন্ত্রীর বক্তব্য: আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন সরকার এই ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত, তাদের (মধ্যে) যাদের ব্যাপারে এই রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি তারা পলাতক থাকার কারণে, এবং দুজন দুটি দেশে থাকার কারণে, তাদেরকে ফিরিয়ে এনে এই রায় কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সে সময় দেশে না থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দায়ের করা হয় মামলা। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিন জনকে খালাস দেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির তথ্য দিতে পারলে পুরস্কার দেবে সরকার : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৫ পলাতক খুনির অবস্থানের তথ্য দিতে পারলে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবাদিক ফোরামের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির খবর আমরা জানি। একজন আমেরিকায় এবং আরেকজন কানাডায়। বাকি পাঁচজন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। যে এদের তথ্য দেবে সরকার তাদের পুরস্কৃত করবে।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, আমরা অনেক চিঠিপত্র দিয়েছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েও আমরা আমেরিকার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা সব সময় বলে, এ ইস্যুটা তাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আছে। মাঝখানে অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের দেশে যে রাশেদ চৌধুরীর নামে মামলা হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য চেয়েছেন। আমরা সব তথ্য তাকে দিয়েছি। আমরা এখন স্টেট ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রোস করলে তারা বলে, এটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে।

কানাডায় অবস্থান করা খুনি নূর চৌধুরী প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কানাডিয়ান সরকার তাকে ফেরত দিচ্ছে না। ওরা ফাঁসির রায় কার্যকর করে এমন দেশে খুনিদের পাঠায় না। এতে গিয়ে সব খুনিরা ওখানে গিয়ে আশ্রয় নেবে।

রাশেদ-নূরকে না ফেরত দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার সমালোচনা করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যেখানে আইন অত্যন্ত শক্তিশালী, সেখানে তারা খুনিদের আশ্রয় দিতে পারে না। যে খুনিরা কি না ভয়ঙ্কর কাজ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ করে মোমেন বলেন, প্রবাসীদের বলব, খুনিরা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা খুনির বাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। অন্তত মাসে একবার হলেও এটা ঘটা করে করেন, তাদের দেখলে বলেন- ‘খুনি যাচ্ছে’। এতে করে তারা মনঃপীড়ায় পড়বে। ওখানকার সাংবাদিকদের নিয়ে আপনারা আন্দোলন করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরাতে সরকার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ