হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরানোর তাগিদ

হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরানোর তাগিদ

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে মানুষের মধ্যে নগদ টাকা ধারণের প্রবণতা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। দৈনন্দিন কেনাকাটাসহ বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে সাধারণভাবে মোট অর্থের ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষের হাতে নগদে থাকে। কিন্তু এখন তা ১৬ শতাংশে উঠেছে। আবার ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য এক বছর আগের ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে সব ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে ব্যাংকার্স সভায় এ চিত্র তুলে ধরা হয়। তারল্য সংকট মেটাতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরানোর তাগিদ দিয়েছেন বলে সভা সূত্রে জানা গেছে।

ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে, তা অতিরিক্ত তারল্য হিসেবে বিবেচিত। পুরো ব্যাংক খাতে এখন সম্মিলিতভাবে ৪ হাজার কোটি টাকার কম উদ্বৃত্ত থাকলেও কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংক নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৪ শতাংশ নগদ জমা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে তারা জরিমানার মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সাধারণভাবে ২ লাখ ৫৫ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা থাকে। এর আগে কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পর গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে ছিল সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এর পর আবার ওই অর্থ ব্যাংকে ফিরলেও এখন তা বেড়েছে।

উদ্বৃত্ত তারল্য মানেই অলস, তেমন না। উদ্বৃত্ত অর্থের বেশির ভাগই সরকারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সিআরআর হিসেবে নগদে ৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। আর এসএলআর হিসেবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১৩ শতাংশ এবং ইসলামিক ব্যাংকের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয়। ধরা যাক, গত জুনে সিআরআর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখার কথা ৭০ হাজার কোটি টাকা। তবে সম্মিলিতভাবে হয়তো আছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আবার এসএলআর হিসেবে হয়তো রাখার কথা ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে আছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মানে, দুয়ে মিলে ৫ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকল। তখন এই ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে এমনিতেই মানুষের নগদ টাকার দরকার বেশি হয়। তখন নগদ টাকা ধরে রাখার প্রবণতা একটু বাড়ে। তবে সমাজে দুর্নীতি বাড়লে মানুষের কাছে নগদ টাকা বেশি থাকে। এ ছাড়া আমানতের সুদহার যখন মূল্যস্ফীতির নিচে নামে, মানুষ তখন ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হয়। সে মনে করে, ব্যাংকে টাকা রেখে তো লাভ নেই। সুতরাং, জমি, ফ্ল্যাট ও স্বর্ণের মতো স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ করে।

ব্যাংকার্স সভা শেষে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাশলেস করার জন্য বর্তমানে অনেক ধরনের ডিজিটাল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে মানুষের কাছে নগদ হোল্ডিং কমার কথা। অথচ মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে। আস্থাহীনতার কারণে এমন ঘটে। এখন সব ব্যাংককে সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে আস্থা বাড়িয়ে এ টাকা ব্যাংকে ফেরানোর জন্য বলেছেন গভর্নর।

আমদানি বকেয়ার তথ্যে বড় পার্থক্য

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আমদানি-রপ্তানির ভুল তথ্য দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। প্রতিটি শাখা থেকে এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে (ওআইএমএস) তথ্য আপলোড করতে হয়। এ ড্যাশ বোর্ডে গত জুন পর্যন্ত আমদানি বিল বকেয়া দেখাচ্ছে ৪ হাজার ৯ কোটি ডলার। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে আলাদাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বকেয়ার পরিমাণ পেয়েছে ২ হাজার ৩৭৩ কোটি ডলার। এর মানে, ব্যাংকে সংরক্ষিত তথ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি বকেয়ার তথ্যে ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলারের পার্থক্য দেখা দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা।

দুই তথ্যে এত বড় পার্থক্যের কারণ জানতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে যথাসময়ে ও সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রতিটি এলসির তথ্য আলাদাভাবে দেওয়ার পাশাপাশি একটি ব্যাংকের ওই দিনের সব এলসির তথ্য একত্রে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তবে অনেক ব্যাংক তা মানছে না। আগামী দুই মাসের মধ্যে এ নির্দেশনা পরিপালন করতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এত পার্থক্যের কারণ ব্যাংকগুলোই ভালো বলতে পারবে। তবে শাখা থেকে ভুল রিপোর্টিংয়ের কারণে এমন হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

ফেরত আসেনি ২৪ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়

পণ্য রপ্তানি হলেও অর্থ ফেরত আসেনি ২৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের। মোট ১৪ হাজার ৭১৪টি এক্সপোর্ট বিলের বিপরীতে এ অর্থ বাইরেই থেকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ইএক্সপির বিপরীতে কাস্টমস থেকে বিল অব এক্সপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে। ফলে রপ্তানির জন্য উপস্থাপিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। কেননা, এসব বিল অব এক্সপোর্ট বাতিল বা স্থগিত হয়েছে এমন কিছু জানানো হয়নি। পরে এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে রপ্তানির অর্থ ফেরত আসেনি। যথাসময়ে রিপোর্ট না করায় দেশের মোট রপ্তানির সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। আবার রপ্তানি বিল মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় ব্যাংক নগদ সহায়তা দিচ্ছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া যায় না। এখন থেকে ঠিকমতো তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মামলায় আটকা ২ লাখ ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা

ঋণ আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ দিয়েছেন গভর্নর। আদালতে মামলার পাশাপাশি বিকল্প বিরোধের মাধ্যমে অর্থ আদায় বাড়াতে বলেছেন। বৈঠকে উত্থাপিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ২ লাখ ১৪ হাজার ২৮২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটকে আছে ২ লাখ ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। জানুয়ারি-মার্চ ২০ হাজার ৭৩০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। প্রথম ত্রৈমাসিকে নতুন করে ১৪ হাজার ৬৫০টি মামলা হয়েছে। এর বিপরীতে অর্থের পরিমাণ ২৭ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।

এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও তৎপর হতে বলেছে ব্যাংকগুলোকে। মামলার পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে অর্থ আদায়ে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ