বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আবারও দিল্লির হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। রাশিয়া চীন ভারত সরকার বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় হস্তক্ষেপ করায় আমেরিকা সরকার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না। এতদিন বিষয়গুলো পর্দার আড়ালে থাকলেও গতকাল ভারতের শীর্ষ একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে ফের বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে— ভারতের বার্তায় বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। বিএনপি বলছে— ভারতের হস্তক্ষেপে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বলছে— একটি নতুন উত্তেজনা তৈরি হবে। ভারত নিয়ে একটি ঝুঁকি তৈরি হবে। তবে এটি হয়তো ভারতের সবাই চাইবে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভারত সরকার যেমন প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে, এবার হয়তো অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন— বড় যে রাষ্ট্রগুলো রয়েছে তারা তাদের জাতীয় স্বার্থে নিরাপত্তার বিষয় যেখানে স্বস্তি মনে করবে সেখানে তারা কথা বলে থাকে নির্বাচনের আগে। এটি নতুন কিছু নয়, পুরোনো বিষয়। বাংলাদেশ ভারত রাশিয়া চীনের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ঠিক ভালোভাবে নিতে পারছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ভারত মেনে নিতে পারছে না। এ জন্য নিজেদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলছে। দিন শেষে জনগণই সব কিছু ঠিক করবে।
জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার পাশে রয়েছে ভারত। আমেরিকাকে পাঠানো এক কূটনৈতিক বার্তায় অবস্থান স্পষ্ট করেছে দেশটি। বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার অবস্থানের সঙ্গে সহমত নয় ভারত। কূটনৈতিক নোটে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত ও আমেরিকা কারও জন্যই সুখকর হবে না। কারণ হাসিনা সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতের মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে ভারত। আমেরিকা জামায়াতকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু ভারত মনে করে, জামায়াত একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। ভারতের বার্তায় এ কথা স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের বার্তা দেয়াকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয় বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়ে এই ভূখণ্ডে ভারত ও আমেরিকার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তাই ভারত আমেরিকাকে কিছু বললে তারা তাদের স্বার্থে বলেছে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি ভারত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেটি হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রকাশিত প্রতিবেদন যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা মনে করি, সেটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য শুভ হবে না।’ আজকে বাংলাদেশে যে সংকট, সেই সংকটের মূলে হচ্ছে এই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের ওপরে যে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দিয়ে, বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস গড়ে তুলে ‘টোটালি একটি ডিপ স্টেট’ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ যারা গণতন্ত্রের কথা বলে সব সময়, তাদের কাছে এটি অপ্রত্যাশিত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘২০১৪ সালে সুজাতা সিং প্রকাশ্য আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে, কথা বলেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশের জনগণ ইন্ডিয়ার প্রতি যে ভালোবাসা ছিল তা থেকে দূরে সরে গেছে। ভারতকে এখন দেশের মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত এখন গণতন্ত্রের শত্রু। ভারতের উচিত জনগণের পক্ষে কথা বলা, কোনো দলের পক্ষে নয়। বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে যদি কেউ হস্তক্ষেপ করে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আনন্দবাজার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা এখনো সত্য কি-না, আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশে যেমন সরকারের দালাল রয়েছে, তেমনি ভারতেও কিছু সরকারের দালাল রয়েছে। সুতরাং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা আসার আগ পর্যন্ত আমি এটি বিশ্বাস করি না।’
বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘সমপ্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন সরকারের যে বৈঠক হয়েছে সেখানে আমরা আশা করেছিলাম, বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হতে পারে কিন্তু সেটি আমরা দেখিনি। কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিষয় নিয়ে আমেরিকাকে যে বার্তা দেয়া হয়েছে সেটি কতটুকু সত্য তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, ভারত এবার বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে সংযত নীতি গ্রহণ করেছে। বেফাঁস কোনো মন্তব্য এখনো শুনতে পাইনি। যদি ওই বার্তা সত্য হয়েও, থাকে তাহলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিষয় নিয়ে এ দেশের মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মৌলিক গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে আমি মনে করি, ভারত সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ভূমিকা দেখাবে না। তারা এ দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়। তবে এটি ঠিক, ভারতের অবস্থান থাকলে এবার পরিবেশ অনুকূলে থাকবে না। একটি নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। ভারত নিয়ে একটি ঝুঁকি তৈরি হবে, এটি হয়তো ভারতের সবাই চাইবে না। ১৮ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে হয়তো ভারতের অবস্থান শেষ পর্যন্ত থাকবে না বলে আমি মনে করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিদেশিরা সবসময় তাদের কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলে। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বলেছিল তখন বিরোধী যারা ছিল তারা খুশি ছিল। এখন ভারত যখন সরকারের পক্ষে কথা বলেছে, তখন আবার বিরোধীরা নাখোশ হয়েছে। আমরা সবসময় দেখি বড় যে রাষ্ট্রগুলো রয়েছে তারা তাদের জাতীয় স্বার্থ নিরাপত্তায় যেখানে নিরাপদ মনে করবে সেখানে তারা কথা বলে। এটি নতুন কিছু নয় পুরাতন বিষয়। বাংলাদেশ ভারত রাশিয়া চীনের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ঠিক ভালোভাবে নিতে পারছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ভারত মেনে নিতে পারছে না। এ জন্য নিজেদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলছে। তবে আমি মনে করছি, আনন্দবাজারের প্রতিবেদন খুব বেশি প্রভাব পড়বে না, এ দেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।’