বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হয় আ.লীগ

বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হয় আ.লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত, এলোমেলোভাবে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন মানবদেহ। একটু আগে যে মানুষগুলো ছিল উচ্ছ্বসিত, হঠাৎ অতর্কিত গ্রেনেড হামলা ও বিস্ফোরণে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুরো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও এর আশপাশের এলাকা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে টানা গ্রেনেড হামলার পর এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়। প্রায় দুই দশক আগে ঘটে যাওয়া ওই গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় অ্যাভিনিউ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশা-ভ্যানে করে আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অনেককে দেখা যায় রাস্তায় পড়ে আকুতির চোখে সাহায্যের আবেদন করছেন, তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আহতদের সহায়তা ও হাসপাতালে নেয়ার কাজে এগিয়ে আসেন।

তখন বিদেশি গণমাধ্যমকে যা বলেছিলেন শেখ হাসিনা : ‘কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে’— ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরপরই একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী ও এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ওই সময়ই এই হামলার জন্য তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন এবং হামলার দায় মাথায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার একটি। ওই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাবও ফেলেছে।

আদালতের পর্যবেক্ষণে যেভাবে উঠে আসে ঘটনাটি : বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত থাকার দায়ে তৎকালীন সরকারের দুজন মন্ত্রীসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার একটি আদালত। লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টু ছিলেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। এছাড়া, সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন অভিযুক্ত। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ওই রায় দেয়া হয়েছিল।

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় সাজা ঘোষণার পাশাপাশি আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্তব্য, যা মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা পরবর্তীতে গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতেই ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে তখন উঠে এসেছিল। আদালতের রায় ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। তারেক রহমানের হাওয়া ভবনে বসে এই হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে।’ তবে তারেক রহমানের দল বিএনপি সবসময়ই এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। হাওয়া ভবন সম্পর্কে আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘তারা এক ও অভিন্ন উদ্দেশে এই ষড়যন্ত্র করে আইনের আশ্রয়ে এই অপরাধীদের সোপর্দ না করে তারা এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করেছে।’

 

রায়ে বলা হয়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও আলামত ধ্বংসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ পরিকল্পনার অপরাধে তাদের যাবজ্জীবন দেয়া হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এটি ছিল পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা, যা তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হয়। রায়ে ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয় আদালত। মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, তখন আদালতের পর্যবেক্ষণে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল যে, ‘রাজনীতি মানে কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ?’ রায়ে বলা হয়েছিল, ‘এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শতবিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে? রাজনীতিতে এমন ধারা চালু থাকলে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।’ রায় ঘোষণার পর আইনজীবীদের উদ্ধৃত করে আদালতের আরেকটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছিল গণমাধ্যমে। তাতে বলা হয়েছে, আদালত এ দেশে আর এমন হামলার পুনরাবৃত্তি চান না মন্তব্য করে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ওপর হামলা বা রমনা বটমূলে হামলার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না’। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে বলেও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, তখন রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেছিলেন যে রাজনৈতিক জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।

যেভাবে রক্ষা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন সিনিয়র নেতারা। দলটির প্রধান এবং তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ছিলেন ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে রাস্তায় একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বিকেল ৩টা থেকে দলটির কিছু মধ্যম সারির নেতা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। বিকেল ৪টার দিকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য দেয়ার পালা। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখনও এসে পৌঁছাননি। দলের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। ওই সমাবেশে তখন উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হেসেন আমু। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, নেত্রীর (শেখ হাসিনার) বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনলাম। প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, এদিক-ওদিক তাকালাম। তখন চারপাশে চিৎকার শুনতে পেলাম। এভাবে দফায় দফায় বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠে। সমাবেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রথমে বুঝতে পারেননি যে এটি ছিল গ্রেনেড হামলা। অনেকেই ভেবেছিলেন বোমাহামলা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করেছিলেন। যখন গ্রেনেড হামলা শুরু হলো, তখন মঞ্চে বসা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা শেখ হাসিনার চারপাশে মানব ঢাল তৈরি করেন, যাতে তার গায়ে কোনো আঘাত না লাগে। যেসব নেতা শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানব ঢাল তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। তখন মোহাম্মদ হানিফের মাথায় গ্রেনেডের আঘাত লেগেছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের শেষের দিকে তিনি মারা যান।

আইভি রহমানসহ ২২ নেতাকর্মী শাহাদাত বরণ : আওয়ামী লীগ দলীয় বিবৃতিতে বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী শান্তি সমাবেশ’-এ তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদতে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী। ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেদিন বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতাকর্মী শাহাদাত বরণ করেন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। আহত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকদের অনেকে শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ মানবেতর জীবন যাপন করছেন এখনো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে সংগঠনের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এমপিসহ দলের প্রথম সারির জাতীয় নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ওই ঘৃণ্য হামলা চালায় ঘাতকচক্র। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় গুলি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি আহত হন, তার শ্রবণশক্তি চিরদিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিবসে সকাল ১১টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে দলটি। আজ বেলা সোয়া ১১টায় ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণে আলোচনা সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে উপরোক্ত কর্মসূচিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতৃবৃন্দ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে সারা দেশে সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদবিরোধী বিভিন্ন উপযোগী কর্মসূচি পালন করার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের সব স্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

জাতীয় রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ