অনলাইনভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা এমটিএফই টানা ৮ বছর দেশে অবৈধভাবে ব্যবসা করেছে কোনো লাইসেন্স ছাড়াই। এমএলএম ব্যবসা করতে হলে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতর বা আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন করতে হয়। সেখান থেকে লাইসেন্স পাওয়ার পরই ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে কোনো প্রতিষ্ঠান। অথচ এমটিএফই নিবন্ধনের জন্য আরজেএসসিতে কোনো আবেদনই করেনি। তাই লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে ব্যবসা করে সাধারণ মানুষের ২০-২২ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে লাপাত্তা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা গেছে, এমটিএফইর লাইসেন্স আছে কি না সেটি জানতে আরজেএসসিকে গত ২১ আগস্ট চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আরজেএসসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এমটিএফই এমএলএম ব্যবসার জন্য কোনো লাইসেন্স নেয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের দায়িত্বে থাকা উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলী গতকাল সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা আরজেএসসিতে চিঠি দিয়ে বলেছিলাম তিন কর্মদিবসের মধ্যে এমটিএফইর লাইসেন্স আছে কি না সেটি জানাতে। জবাবে আরজেএসসি থেকে জানানো হয়েছে, এফটিএফই লাইসেন্স নেওয়ার জন্য কোনো আবেদনই করেনি। আর আবেদন না করলে তো লাইসেন্স নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অর্থাৎ এমটিএফই লাইসেন্স ছাড়াই এতদিন অবৈধভাবে ব্যবসা করে গেছে।’
অন্যদিকে আরজেএসসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মঙ্গলবার বলেন, ‘২০১৮ সালের পর থেকে আর কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমএলএম লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠান এমএলএম লাইসেন্স নেওয়ার জন্য আরজেএসসিতে আবেদন করেছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও তাদের নিবন্ধন বা লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। কিন্তু আরজেএসসির এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ আদালতে রিট করেছে। আদালতে রিট আবেদন করেই ওই ১৪ প্রতিষ্ঠান দেশে এমএলএম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে এমটিএফই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।’
ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধ নয় : মোস্তাফা জব্বার
অন্যদিকে এমটিএফইসহ অনলাইনের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা এবং অবৈধ ও যাচাইবিহীন আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। সভাশেষে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, একটি বিষয় স্পষ্ট যে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে বৈধ নয়। কাজেই কেউ যদি এটিতে লেনদেন করে থাকেন, সেটি সম্পূর্ণ অবৈধ। যখনই কারেন্সির (মুদ্রা) প্রশ্ন আসে, এটির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারেন্সির আসা-যাওয়া থেকে শুরু করে লেনদেনসহ যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আমরা যারা ডিজিটাল দুনিয়াতে কাজ করি, এটি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ থেকেই যায়।
তিনি আরও বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি আসার পর থেকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আপনারা কী করেছেন? এর বিষয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করেন। ডিজিটাল দুনিয়াতে একটি অ্যাপ চলছে, এটি এমন কিছু ঘটনা না যে আমি চট করে তাতে সব মনোযোগ দিয়ে বসে থাকব।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে মোস্তাফা জব্বার বলেন, আপনারা জেনে অবাক হবেন, গতকাল বা আগের দিন পুলিশের কাছে কিছু অভিযোগ এসেছে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তো কোনো অভিযোগই আসেনি। যেকোনো বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার পড়লে প্রথমে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। তারপর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন আসে।
এটি আমাদের বাস্তব দুনিয়ার মতো না যে অপরাধ হচ্ছে, সেই অপরাধ কেবল আমাদের দেশের পরিসীমার মধ্যে হচ্ছে এবং ভৌগোলিকভাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারছি। আপনারা যে অপরাধের কথা বলছেন, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হয়নি। তবে বাংলাদেশের মানুষ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, অ্যাপটি দুবাইভিত্তিক। যারা টাকা দিয়েছেন বা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা বাংলাদেশসহ বিশে^র অন্যান্য জায়গা থেকে অংশ নিয়েছেন। এটি ডিজিটাল দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম। এতে লেনদেনের ক্ষেত্রে অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেনদেন করা দরকার, তারা তা করছেন। তিনি আরও বলেন, সেদিক থেকে আমরা যতটুকু বুঝি যে এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। তাদের কাছে অভিযোগ এসেছে বলে আমরা জানি। যার ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এ সম্পর্কে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের পরিমাণের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে মিডিয়াতে যা দেখেছেন, তার সবই আন্দাজ। প্রকৃত তথ্য আমাদের পাওয়ার কথা না। আর্থিক বিষয়গুলোর তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে। তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, ‘ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিভিন্ন সংস্থাকে এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি কাজ করবে এবং বিটিআরসি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে যার যার দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
১৭ আগস্ট হঠাৎ গায়েব এমটিএফই : গত ১৭ আগস্ট হঠাৎ এমটিএফই অ্যাপ বন্ধ করে লাখ লাখ মানুষের বিনিয়োগ করা অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। উল্টো তাদের ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই। বাংলাদেশ ছাড়াও নাইজেরিয়া ও শ্রীলঙ্কার অসংখ্য মানুষও বিনিয়োগ করেন এই প্ল্যাটফর্মে। এটি অনেকটা পঞ্জি স্কিমের মতোই ছিল। বিনিয়োগকারীরা নতুন কাউকে দিয়ে বিনিয়োগ করাতে পারলে অতিরিক্ত বোনাস দেওয়ার মতোও অফার ছিল এমটিএফইর। প্রথমদিকে এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারেরও বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। কেউ জমানো টাকা বিনিয়োগ করেছেন, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেন। কিন্তু গত ১৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা তোলার সেবা বন্ধ করে দেয় এমটিএফই