ঠিক এক মাস আগে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে বিএনপি পরিস্থিতি উতরানোর পথ খুঁজছে। কী ধরনের কর্মসূচি দিলে আন্দোলন পরিস্থিতি বদলাবে, এখন তা নিয়ে ভাবছে দলটি। পাশাপাশি পশ্চিমাদের ওপর দলের প্রত্যাশা ও নির্ভরতা বাড়ছে। এত দিন স্বীকার না করলেও এখন বিএনপির ভেতরে এই আলোচনা আছে যে গত ২৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কমিটি বাতিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে ১২ দিনের বিরতি দেওয়া হয়।
গত ১১ আগস্ট থেকে গণমিছিল ও পদযাত্রার মতো সাধারণ কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপি। আরো কিছুদিন ঘুরেফিরে এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানায়।
কিন্তু এ ধরনের কর্মসূচি যে সরকার পতনের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারবে না, সে ব্যাপারেও সচেতন আছেন নেতারা।
এ অবস্থায় সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনার চিন্তা শুরু হয়েছে দলে। কিন্তু কী সেই ভিন্নতা, তা এখনো পরিষ্কার নয় নেতাদের কাছেই। তবে দলের কেউ কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আন্দোলন জোরদার করার পক্ষে।
দলীয় সূত্র জানায়, গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বৈঠকে কমিটির সদস্যদের চূড়ান্ত আন্দোলন কবে শুরু করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য বলেন। নির্বাচনী তফসিলের আগে না পরে আন্দোলন, সে বিষয়ে নেতাদের পরামর্শ চান তিনি। স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলার সময় শীর্ষ নেতৃত্বকে বিমর্ষ দেখা গেছে বলে জানান কমিটির একাধিক সদস্য।
বিএনপির নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলে আন্দোলনের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
কবে, কিভাবে আন্দোলনে গতি সঞ্চার হতে পারে, সে রকম কোনো জোরালো ভাবনা এখনো দলের ভেতর তৈরি হয়নি বলে জানান তাঁরা। নেতারা মনে করেন, নতুন করে আন্দোলন গোছাতে হলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
বিএনপির কর্মকৌশল তৈরিতে ভূমিকা রাখেন এমন একজন নেতা বলেন, এই আন্দোলন নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক বিস্তর। মনে হচ্ছে, তিনি বড় ধরনের মানসিক ধাক্কা খেয়েছেন। এই পর্যায়ে এসে তাই বিএনপি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, তা নিয়ে চিন্তিত শীর্ষ নেতারা।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মতামত নেবেন। তাঁদের মতামত নেওয়ার পর চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন করা হতে পারে।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘আমরা আন্দোলনের কয়েকটি ধাপ সফলভাবে পার হয়েছি। প্রতিটি ধাপে জনগণের সমর্থন পেয়েছি। জনসমর্থন নিয়ে শিগগিরই চূড়ান্ত আন্দোলনের আরো কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
সমীকরণ জটিল
বিএনপির নেতাদের বিশ্লেষণ, আন্দোলনে তাঁদের মূল শক্তি জনসমর্থন, যার কারণে মহাসমাবেশ, গণমিছিল, পদযাত্রা কিংবা জনসম্পৃক্ত অন্যান্য কর্মসূচিতে বড় জমায়েত হয়। কিন্তু কঠোর কর্মসূচিতে সেই সমর্থকদের উপস্থিতি কমে যায়।
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, সরকার রাষ্ট্রশক্তিকে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। দলের নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় অভ্যস্ত হয়ে গেলেও সাধারণ সমর্থকরা হামলা-মামলায় ভয় পাচ্ছেন। এই অবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা কঠিন বলে মনে করেন অনেক নেতা।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্র যখন স্বৈরাচার হয়ে যায় তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে জনগণ বারবার হোঁচট খায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণেরই জয় হয়।
পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে
বিএনপির কোনো কোনো নীতিনির্ধারক মনে করেন, শুধু আন্দোলন করে এখন আর সরকার পতন হয় না। পরাশক্তি দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে মাঠে নামতে হয়। তবে এটা ঠিক, আন্দোলন জমাতে না পারায় এখন পশ্চিমাদের ওপর বিএনপির নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে।
কূটনীতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রাখেন দলের এমন নেতাদের একজন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন বেশ শীতল। কিন্তু সরকারের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি ততটা সক্রিয় নয়। বন্ধুরাষ্ট্রকে নিজের পক্ষে আনতে বিএনপি তেমন কৌশলী হতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি রেখে যেভাবে কর্মকৌশল সাজানো উচিত তা-ও হয়ে উঠছে না।