এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ  আমদানি কমিয়ে অর্থনীতির সংকট সমাধান সম্ভব কি

এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে অর্থনীতির সংকট সমাধান সম্ভব কি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। এর আগে ২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের মার্চে রেকর্ড ৯৫১ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। সে সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে আমদানির নতুন এলসি অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত অর্থে আমদানির চাহিদা কত, সেটি নিয়েই প্রশ্ন ওঠা শুরু করেছে।

 

গত দুই বছর দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার অন্তত ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত এক বছরে দেশে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানিনির্ভর পণ্যে। এর বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে। সর্বশেষ জুলাইয়েও দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব হলো, অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা। যদিও এ দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা অভিযোগ তুলছেন।

দেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে আমদানির প্রকৃত চাহিদা কত, এমন প্রশ্নের উত্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে বর্তমানে জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্যসহ প্রায় সব পণ্যের দাম নিম্নমুখী বা স্থিতিশীল। অনেক পণ্যের দাম ২০২১ ও ২০২২ সালের তুলনায় অর্ধেক। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যের দামে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জনগণ দাম কমার সুফল পাচ্ছে না। এ কারণে চেষ্টা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কমছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশের শিল্প খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি পণ্যের এলসি খোলা কমেছে। এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির নতুন এলসি কমেছে ৩৬ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য প্রায় ৩১ শতাংশ ও মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসিও ২২ শতাংশের বেশি কমেছে। একই সময়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানির এলসিও কমেছে ২১ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি ৫০ শতাংশ এলসি কমেছে জ্বালানি তেল আমদানির। গত অর্থবছরেও (২০২২-২৩) এলসি খোলা কমে যাওয়ার এ হার অব্যাহত ছিল। অর্থবছরটিতে নতুন এলসি ২৫ শতাংশেরও বেশি কমেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। আমদানি কমিয়ে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সামলানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি রিজার্ভের ক্ষয় থামানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে। গত ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ সংরক্ষণ নিয়ে এরই মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পার করে বাংলাদেশ। অর্থবছরটিতে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। এতে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এ অবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের এলসির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে গত অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এক্ষেত্রে আমদানি কমে যায় ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আগে তার ব্যাংক প্রতি মাসে ৪০ কোটি ডলারের আমদানি এলসি খুলত। এখন সে এলসির পরিমাণ মাসে ১০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও ডলার না থাকায় তারা এলসি খুলতে পারছে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে বেশি দামে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কেনা যাচ্ছে না। এখন আমদানিকারকরা ব্যাংকের বাইরে গিয়ে রফতানিকারকদের কাছ থেকে দরকষাকষি করে ডলার কিনছেন। এতে প্রতি ডলারের দাম ১১৫-১১৭ টাকায়ও উঠে যাচ্ছে। আবার ব্যাংক এলসি খুলতে না পারায় হুন্ডির বাজার শক্তিশালী ও বড় হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমদানিতে বিধিনিষেধ ও তদারকি বাড়ানোয় গত অর্থবছরে অর্থ পাচার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন সব পণ্যের আমদানিও কমেছে। গত অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণও ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে লেনদেনের সামগ্রিক ঘাটতি (বিওপি) ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক  বলেন, ‘বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ভোক্তারা পণ্য পাচ্ছেন। আমদানি করা বিস্কুট বা বিলাসপণ্যের সরবরাহ কিছুটা কম থাকতে পারে। তাই বলে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কিছু শুনিনি। শিল্পোদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের অনেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করেছেন। সেসব পণ্য এখনো ব্যবসায়ীদের স্টকে থেকে গেছে। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির চাহিদাও কিছুটা কম। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির কারণে বাণিজ্যনির্ভর মানি লন্ডারিং কমে গেছে।’

চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দাবি করলেও বিপরীত তথ্য দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও ব্যাংক নির্বাহীরা। তারা বলছেন, ডলার সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে অর্থনীতির প্রতিটি খাতই চাপের মুখে আছে। আমদানিনির্ভর শিল্প ও সেবা খাতের ব্যবসা একেবারেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। রফতানিমুখী শিল্প খাতেও সংকটের প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ক্ষরণ চলছে, সেটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।

দেশের অর্থনীতির নীতিকৌশলগুলো ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।  এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ডলারের সংকট কাটিয়ে উঠতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। সেটির প্রভাবেই দেশের আমদানিনির্ভর শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় স্থবিরতা চলছে। দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগও নেই। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি পরিস্থিতিতেই সেটি দৃশ্যমান। রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও এলসি খুলতে পারছে না। আমদানি কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ মুদ্রানীতি বা রাজস্ব নীতিতে দৃশ্যমান নয়। এসব ক্ষেত্রে ভুল নীতি ও কৌশলই নেয়া হচ্ছে।’

আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের রফতানিমুখী বস্ত্র ও পোশাক খাতে সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বলে জানান বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)। এ শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, ‘আমদানিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানেই বোঝা যাচ্ছে যে শিল্পগুলোর কর্মকাণ্ড সংকুচিত হচ্ছে। উৎপাদন কমে আসছে। দেশের প্রতিটি শিল্প খাতেই একই অবস্থা। নির্মাণ শিল্প খাতের রড, সিমেন্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাদের বিক্রি ও উৎপাদন কমে গেছে। টেক্সটাইল খাতের অনেক স্পিনিং মিল এখন বসে আছে। যেগুলো চলছে সেগুলোর ৩০-৪০ শতাংশ সক্ষমতাও ব্যবহার হচ্ছে না। সরকারের নীতির কারণে হোক, নিজস্ব কারণে হোক বা বাজার চাহিদার কারণে হোক; শিল্প খাতগুলোর কর্মকাণ্ড নিম্নমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলোয় মনে হচ্ছে, শিল্প প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডের চেয়েও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যাংকগুলোকে তারা কত কম ঋণপত্র খোলার অনুমতি দেবে।’

প্রায় একই ধরনের কথা বলছেন স্কয়ারের নির্বাহী পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘টেক্সটাইল খাতের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মূলধনি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কম। কভিডের পরপর কিছু হলেও এরপর টেক্সটাইল খাতে বড় কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এ মুহূর্তে পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা নিম্নমুখী। ফলে ক্রয়াদেশ তেমন একটা আসছে না, সবাই সাপ্লাই চেইনকে শ্লথ করে দিয়েছে।’

চাহিদামতো কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে না পারায় এরই মধ্যে উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন ভারী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইস্পাত খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা। মজুদ কাঁচামাল দিয়ে ফিনিশড পণ্য উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও স্ক্র্যাপ গলিয়ে বিলেট কিংবা অ্যাঙ্গেল তৈরির প্লান্টের উৎপাদন কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীদের এ বিড়ম্বনা না কাটলে অচিরেই অনেক শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

দেশের বৃহৎ ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের (বিএসআরএম) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত জানান, উৎপাদন ঠিক রাখতে অন্তত চার মাসের কাঁচামাল স্টক করে রাখতে হয়। কিন্তু চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে না পারায় পর্যাপ্ত কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

তবে সংকটের মধ্যেও দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার স্থিতি বেড়েছে। জুলাই শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯০ কোটি বা ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুলাইয়ে এ স্থিতি ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। সে হিসাবে ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি বেড়েছে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ