নিজস্ব প্রতিবেদক
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি সোনা চুরির ঘটনায় বাইরের কেউ নয়, ভেতরের লোকজনই জড়িত। প্রাথমিক তদন্তে এমনটিই মনে করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটজনকে গতকাল সোমবার থানায় নিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) পদমর্যাদার চারজন এবং গুদামের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা সিপাহি চারজন।
সন্ধ্যায় ডিএমপির উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোনো সন্তোষজনক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এই চুরির সঙ্গে ভেতরের লোকজনই জড়িত রয়েছে। তাদের শিগগিরই আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিমানবন্দরের কাস্টম হাউস এলাকা থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু সিসি ক্যামেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে কাস্টম হাউসের গুদামের ভেতর কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। এ ঘটনায় একাধিক কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসছে। নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে চক্রটি সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখাসহ চুরির সব রকম আলামত নষ্ট করার চেষ্টা করেছে।
এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করেছে কি না এমন প্রশ্নে বিমানবন্দর থানার ওসি আজিজুল হক মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা গুরুত্বসহ কাজ করছি। এ ছাড়া সিআইডি, ডিবিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে।’
গুদাম থেকে সোনা চুরির ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় রবিবার দিবাগত রাতে কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের।
ওই দিনই শুল্ক বিভাগের একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
সোহরাব হোসেন মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা শনিবার সকাল ৯টার দিকে কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনারকে মোবাইল ফোনে জানান, গুদামের স্টিলের আলমারির তালা ভাঙা। এরপর তাত্ক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরের দায়িত্বরত যুগ্ম কমিশনার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। আগের দিবাগত রাত আনুমানিক ১২টা ১৫ মিনিটে গুদামের তালা বন্ধ করে চাবি নিয়ে চারজন কর্মকর্তা একসঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস এলাকা ত্যাগ করেন।
পরে যুগ্ম কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনাররা এবং ঢাকা কাস্টমস কমিশনার গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে আলমারির তালা ভাঙা এবং গুদামের পূর্ব পাশে ওপরের দিকে টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান।
এজাহারে বলা হয়, শনিবার দিনগত রাত সোয়া ১২টা থেকে পরদিন রবিবার সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সোনাগুলো চুরি হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বিমানবন্দরের ভেতরে সব জায়গা সিসি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। পুরো বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। এত নিরাপত্তার মধ্যে গুদাম থেকে সোনা চুরি হওয়া ও কাস্টম হাউসের গুদামের ভেতরে সিসি ক্যামেরা না থাকার বিষয়টি সন্দেহজনক। কাস্টমস কর্মকর্তাসহ বিমানবন্দরসংশ্লিষ্ট কেউ এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলেও তারা ধারণা করছে। তবে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানান।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, গুদামঘর সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকলে ঘটনায় জড়িতদের বের করা সহজ হতো। তিনি বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, গায়েব হওয়া সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এসব সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যাওয়ার কথা, এখানে থাকাটা উদ্বেগজনক।’
কাস্টম হাউসের নিজস্ব গুদামে যে কারো যাওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই যেতে পারেন। এই সোনা চুরির আলামত নেই বললেই চলে। আমাদের কাছে যে তথ্য-উপাত্ত আছে, সেখানে বাইরে থেকে কেউ এসে সোনা নিতে পারবে না। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়া যে আলমারিতে সোনা ছিল সেগুলো ভাঙা সহজ না। আর সেখানে যেসব যন্ত্রপাতি ছিল তা দিয়েও আলমারি ভাঙা সম্ভব না।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আটক ব্যক্তিদের বক্তব্যে ব্যাপক গরমিল রয়েছে। একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। এতে সন্দেহ বাড়ছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার পাশে শুল্ক হাউসের গুদামে দায়িত্ব পালন করেন চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহি। চার রাজস্ব কর্মকর্তা হলেন মাসুদ রানা, সাইফুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকতার শেখ। চার সিপাহি হলেন রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরের চুরি যাওয়া ওই ভল্টের দায়িত্বে ছিলেন দুই কর্মকর্তা শহিদুল ও শাহেদ। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ আদেশে তাঁদের দুজনকে বদলি করে একই পদমর্যাদার আকরাম ও মাসুমকে দেওয়া হয় দায়িত্ব। কিন্তু তাঁরা গুদামে সংরক্ষিত সামগ্রীর হিসাব নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আকরাম ও মাসুমকে বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা করেন। এক পর্যায়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার লুবানা ইয়াসমিন গত ২১ আগস্ট শহিদুল ও শাহেদের বদলির আদেশ গুদামের মূল্যবান সামগ্রী বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন।
ঢাকা কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ টিমের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, ঘটনায় যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ‘এল’ শেপ গুদামটির মাথায় যেখানে এসি আছে সেখানে একটি গর্ত দেখা গেছে। সেটি দিয়ে মানুষ প্রবেশ করা সম্ভব।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ বলেছেন, গুদামে অনেক লকার থাকলেও সোনা চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এই কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে, তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, চুরির বিষয়টিতে গোয়েন্দা পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। একাধিক টিম কাজ করছে। কারা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে পুলিশ।