সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। নেতারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে যেভাবে তড়িঘড়ি করে নেতাকর্মীদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, তাতে ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় তারা দেখছেন না।
সম্ভাব্য কর্মসূচি সম্পর্কে নেতারা জানান, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়ায় মামলার রায়ের প্রতিবাদে রাজপথে সমাবেশ করা হবে। আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। থাকবে সভা-সেমিনারও। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব কর্মসূচি ঘোষণার সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এসব দলের নেতাদের পরামর্শে ‘আদালতকেন্দ্রিক’ আন্দোলনের পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘অচিরেই নতুন কর্মসূচি আসবে। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আছি। ধারাবাহিক আন্দোলনে পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মসূচির ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়। এটিই আন্দোলনের ধারা।’
এদিকে ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে আগামী শনিবার বিকালে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-সাংবাদিকদের ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে সমাবেশ করবেন সমমনা বুদ্ধিজীবীরা। একই দিনে যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও কৃষক দলের যৌথভাবে রাজনীতিতে সমাবেশ করার কথা রয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারসহ সাজা নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরবেন নেতারা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো, আদালত যেন সরকারের চাপ অগ্রাহ্য করে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।’ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সরকার
আদালতকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছে। নির্বাচনের আগেই বিরোধী নেতাদের সাজা দিতে দ্রুত বিচারকার্য শেষ করা হচ্ছে।
গত রবিবার দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিবদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই বৈঠকেও বেশির ভাগ নেতা আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেন। এই বৈঠকের প্রস্তাব স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তুলে ধরেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানায়, আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সব সদস্য একমত হয়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল রিজভী বলেন, ‘পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের আটক করছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের একটা আশা উচ্চ আদালতে বিচার পাব। কিন্তু সেই আশাও শেষ।’
স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সবাই জেনে গেছে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা কীভাবে চলছে। নিউইয়র্ক টাইমস এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন করেছে। এরপর গত সোমবার একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের মামলার বিষয়ে আদালতকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই অভিযোগও তুলেছেন। তাহলে সেখানে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কেন চুপ থাকবে?’
আদালতকেন্দ্রিক কর্মসূচির পরিকল্পনা তুলে ধরে দলের এক নেতা বলেন, ‘বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আদালতের রায়ের প্রতিবাদে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঢাকায় একটি সমাবেশ করা হবে। সেই সমাবেশ থেকে আদালতের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ তুলে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। এরপর সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, আদালতে কীভাবে সেই মামলা বিচারকার্য চলছে, তা তুলে ধরতে একটি সেমিনার হবে। বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে ওই সেমিনারে আদালতে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাকর্মীদের ‘দমনপীড়ন ও সাজা’ দেওয়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হবে। এরপর বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। একইদিন বিএনপিও একই দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করতে পারে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি নেতারা দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, মধ্য অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। কারণ বিএনপি নেতাদের ধারণা, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কিংবা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। রবিবার বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে জ্যেষ্ঠ নেতারাও একই অভিমত তুলে ধরেন। তারাও বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলনে ভিন্নতা আনতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগেই মধ্য অক্টোবরে আন্দোলন শেষ করতে হবে। বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, চলতি মাসের শেষ দিকে আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য তারা মতামত দিয়েছেন।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সঠিক পথেই আছে। এখন কর্মসূচির পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলার সাংঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘ঢাকার গেটওয়েগুলোয় যেসব জেলা আছে, চূড়ান্ত কর্মসূচির আগে সেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বা কোনো দুর্বলতা থাকলে, তা নিরসনে যা করার দরকার, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকা জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর দায়িত্ব পড়েছে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ওপর।