ডজনের বেশি সংস্থা, মাঠে একা ভোক্তা অধিদপ্তর

ডজনের বেশি সংস্থা, মাঠে একা ভোক্তা অধিদপ্তর

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের আইনগুলো শক্ত। সরকারি অন্তত ১৪টি সংস্থা তদারকির দায়িত্বে। তবে আইনের যেমন প্রয়োগ নেই, তেমনি দু-একটি ছাড়া বাকি সংস্থার তদারকিও পড়ে না চোখে। এ সুযোগই বারবার নেন ব্যবসায়ীরা। যেমনটি সবশেষ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে হাঁকডাক ছেড়ে পণ্যের দর বেঁধে দিলেও তা কেউই মানছেন না। আমদানিকারক থেকে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ী– যে যার মতো তুলে নিচ্ছেন মুনাফা। এতে তাদের পকেট তাজা হলেও খরচের চাপে ভোক্তার রুগ্‌ণদশা বাড়ছেই। সবচেয়ে বিপদে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার প্রতি পিস ডিম ১২, আলু ও পেঁয়াজের কেজি যথাক্রমে ৩৪-৩৫ ও ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ওই দিনই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘দাম কার্যকরে আইনের কঠোর প্রয়োগ হবে। ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি-প্রাণিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলো দর বাস্তবায়নে মাঠে থাকবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিন দিনেও দর কার্যকর হয়নি।

শনিবার রাজধানীর মগবাজার, হাতিরপুল, শান্তিনগরসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে আলু আগের মতোই ৫০ থেকে ৫৫, দেশি পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি এবং ডিমের হালি ৫০ থেকে ৫৩ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। অন্যদিকে, দর বাস্তবায়নে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া কোনো সংস্থাকেই মাঠে দেখা যায়নি।

ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দর নির্ধারণ শুধু মুখেই, বাস্তবায়নে সরকারের ঢিলেমি স্পষ্ট। এমন না হলে ভোক্তা অধিদপ্তরের পাশাপাশি দায়িত্বে থাকা অন্যান্য সংস্থাকেও মাঠে দেখা যেত। ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিধি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে দিশেহারা হয়ে পড়বেন কম আয়ের মানুষ।

কী বলছেন ভোক্তারা

রাজধানীর মগবাজারে ৫৫ টাকা কেজি দরে আলু কেনার পর বেসরকারি চাকরিজীবী আবদুর রহমান  বলেন, দাম কমেছে পত্রিকা ও টেলিভিশনে। বাজারে ছিটেফোঁটা প্রভাবও নেই। সরকারের নির্দেশনার কথা বললে ব্যবসায়ীরা আমলেই নিচ্ছেন না। উল্টো বলছেন, সরকারের ধোঁকা পাবলিক এখনও বুঝতে পারে না। এসব দর জনগণকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, দাম নির্ধারণে সমস্যার সমাধান হবে না। তদারকি জোরদার করতে হবে। ভোক্তা অধিকার ছাড়া সরকারের কোনো দপ্তর মাঠে নেই। একটা সময় জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, ডিএমপি, বিএসটিআই বাজার তদারকি করলেও এখন তাদের দেখা যায় না। ঢাকায় সিটি করপোরেশনের শতাধিক এবং হাজারখানেক বাজার থাকলেও ভোক্তার টিম মাত্র দুটি। সমস্যা সমাধানে ভোক্তা অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। সঙ্গে বিদ্যমান আইনের সংস্কার জরুরি।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সব সংস্থা নিজেদের মতো মাঠে নামবে– এ সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আমরা আমাদের কাজ করছি অনেকটা একা; বাকি কাউকে তো দেখছি না। এত কম জনবল দিয়ে কীভাবে ১৮ কোটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করব আমরা?’ তিনি আরও বলেন, ‘অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিতেও মাঠে থাকেন। জনবল সংকটে অধিদপ্তরের ডিজিকেও জেলায় জেলায় ঘুরতে হচ্ছে। একটি মাত্র সংস্থা দিয়ে সত্যিই বাজার বশে আনা যাবে কিনা, নতুন করে ভাবতে হবে।’

কেন মাঠে নেই অন্যান্য সংস্থা

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পণ্যমূল্য পর্যালোচনা করে সংস্থার বাজার সংযোগ বিভাগ। এ বিভাগের সহকারী পরিচালক প্রণব কুমার সাহা  বলেন, ‘দাম নির্ধারণের পর দুই দিনই ছুটি ছিল। তদারকির জন্য আমাদের নিজস্ব মোবাইল টিম নেই; সহায়তা নিতে হয় জেলা প্রশাসনের। তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, ঢাকায় রোববার তদারকি করব। ঢাকার বাইরে এখন তদারকি চলছে; জরিমানাসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাইকারি ও উৎপাদন স্তরে দর নিশ্চিত করা গেলে খুচরায় প্রভাব পড়বে। এ জন্য দুই থেকে তিন দিন লাগতে পারে।’

নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৪ সালে দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস নামে একটি সেল গঠন করা হয়। এ সেল বিভিন্ন সংস্থা থেকে পণ্যের উৎপাদন, মজুত, আমদানির পরিমাণ, সংগ্রহ পরিস্থিতি ও বিতরণ ব্যবস্থা, পণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদর, বন্দরে পণ্য খালাসের পরিমাণ, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। অথচ গত তিন দিনে তাদের কাউকেই বাজার তদারকিতে দেখা যায়নি।

এদিকে, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার হিমাগার থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশনা দিয়েছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। গতকাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সরকারি কর্মকর্তা, হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ নির্দেশনা দেন তিনি।

মাঠ পর্যবেক্ষণের তথ্য তুলে ধরে সফিকুজ্জামান জানান, মুন্সীগঞ্জে হিমাগারের মজুতদাররাই আলুর দাম নির্ধারণ করছেন। রসরাজ বাবু নামে একজন তিন মাস আগে যে আলু ২৫-২৭ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন, একই আলু শুক্রবার চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন ৩৭ টাকায়। রসিদের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে না। ফোনে ফোনেই তারা দাম ঠিক করছেন। এখন থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করতে হবে। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করবেন।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ