সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে একদফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।
গতকাল দুপুরে গুলশান বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচির ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে রোডমার্চ কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছিলেন রোডমার্চ তখনই শেষ হবে যখন সরকারের পতন হবে, তিনি এও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে সরিয়ে দিতে দেশের সব রাজনৈতিক দল এখন এক হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বেগম খালেদা জিয়া সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য দল ও জোটকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই থেকে দলটি এখন হার্ডলাইনে। দলে যারা নরম সুরের অবস্থানে রয়েছেন তাদেরকেও বেগম জিয়া তিরস্কৃত করেছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের অচল অবস্থা তৈরি পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেছেন তিনি। সিনিয়র রাজনীতিবিদ যারা রয়েছেন খালেদা জিয়ার নির্দেশনাকে ওয়েলকাম জানিয়েছেন। সেই আলোকে জোট নেতারাও কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। গতকাল সমাবেশ ও পদযাত্রাসহ চার দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্রমঞ্চ। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীও এখন থেকে সিরিজ কর্মসূচি পালন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়নে। গতকাল তারা ঢাকার পান্থপথে বসুন্ধরা মার্কেটের সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আলেমদের মুক্তির দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ দলটিও এখন থেকে মাঠে থাকবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্যান্য সরকার বিরোধী সব দল সরকার পতন নিশ্চিত পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ আদর্শ ও একাধিক ডান বাম দল বিএনপির সঙ্গে একসাথে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকলেও জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোকে দেখা যায়নি। এখন থেকে জামায়াতের সঙ্গে অন্যান্য ইসলামপন্থি দলগুলোকে আলাদা ব্যানারে সরকার পতনে দেখা যাবে। ইতোমধ্যে প্রতি শুক্রবার ইসলামী আন্দোলনসহ একাধিক দল প্রতি শুক্রবার বাদ জুমা আলেম ওলামা ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে যুগপৎ কর্মসূচিতে জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলোও একজোট হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্যে দূরত্ব থাকলেও খালেদা জিয়ার নির্দেশ রয়েছে এ দলটিকে সাথে রেখেই যেন বিএনপি আন্দোলন করে এমন ভাষ্য জামায়াত বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। এখন সবার একই উদ্দেশ্য— সরকার পতন। সেই টার্গেটে বিএনপি সিরিজ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতও মাঠে নেমেছে। সবাই এখন হার্ডলাইনে চলে গেছে। আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চললেও সেটি হয়তো শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকবে না সরকারের গতিবিধির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব সময়ে এবার আর সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বসবে না আলোচনার টেবিলেও।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান আমার সংবাদকে বলেন, সরকার পতনে এখন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। এই সরকারকে সরে যেতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। সরকার যদি আমাদের ভিন্ন দিকে যেতে বাধ্য করে আমরা সেই দিকে যাবো। সরকারের গতিবিধির ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। আমরা আন্দোলনে নেমেছি। এই সরকারকে হটানো পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দিন দিন আমাদের আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের দিকে রূপ নেয়ার পথেই এগুচ্ছে। এই সরকার সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’ জামায়তের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার অবৈধ পথে ক্ষমতায় এসে এ দেশের জনগণের সব অধিকারকে হরণ করেছে। গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনার দাবি শুধু জামায়াতে ইসলামীর নয়, এটি গোটা বাংলাদেশের জনগণের দাবি। আর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের জনগণ রাজপথে নেমে এসেছে। জামায়াতে ইসলামী অতীতেও আন্দোলন করে সফল হয়েছে, এবারও সফল হবে।
বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচিতে যা রয়েছে : বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুরের টঙ্গীতে সমাবেশ। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জের সমাবেশে অতিথি থাকবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ড. আব্দুল মঈন খান। টঙ্গীর সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেটে রোডমার্চ। এতে নেতৃত্ব দেবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরে যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীর সমাবেশে অতিথি থাকবেন মির্জা আব্বাস ও ড. আব্দুল মঈন খান। আর উত্তরার সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই দিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনায় বাদ জুমা সারা দেশে জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে দোয়া। ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালীতে রোডমার্চ। এতে নেতৃত্ব দেবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও বেগম সেলিমা রহমান। ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরে নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিন বাজারে সমাবেশ। প্রধান অতিথি থাকবেন নজরুল ইসলাম খান (নয়া বাজার), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও বেগম সেলিমা রহমান (আমিন বাজার)।
২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ। এতে নেতৃত্ব দেবেন মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী কনভেশন। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ড. আব্দুল মঈন খান। ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন নজরুল ইসলাম খান ও বেগম সেলিমা রহমান (গাবতলী), ড. আব্দুল মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (ফতুল্লা)। ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মহিলা সমাবেশ। এতে থাকবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বেগম সেলিমা রহমান। ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় শ্রমজীবী কনভেনশন। ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে রোডমার্চ। ২ অক্টোবর ঢাকায় কৃষক সমাবেশ। ৩ অক্টোবর কুমিল্লা, ফেনি, মিসরাইল ও চট্টগ্রামে রোডমার্চ। গণতন্ত্র মঞ্চের চারদিনের কর্মসূচি ঘোষণা : সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে চার দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। গতকাল পল্টনের দারুস সালাম ভবনে মঞ্চের অন্যতম শরিক দল ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কর্মসূচির কথা জানান ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু।
লিখিত বক্তব্যে কর্মসূচি ঘোষণা করে শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা, ২৩ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টায় কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।’
এসব কর্মসূচি ছাড়াও আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে ‘সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা কেন সাংবিধানিক নয়?’ ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনীয়তা’, ‘গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক সংবিধান বড় বাধা’ এবং ‘আগামীর বাংলাদেশ সংস্কারের ৩১ দফার আবশ্যিকতা’ শীর্ষক চারটি সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে জানান মঞ্চের এই শীর্ষ নেতা। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন প্রমুখ।