আবদুল মতিন। একসময় ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বিরলী এলাকায় প্রাইম কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইসলামিক আহসান বীমায় ১০ বছর মেয়াদে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে এক লাখ টাকার বীমা করেন। তিন বছর পর প্রিমিয়ামের টাকা জমা দেয়া বন্ধ রাখেন। সেসময় পার্টটাইমে সানলাইফে কাজ করতে গিয়ে কয়েকশ গ্রাহক তৈরি করেন। অনেকের মেয়াদ শেষ হলেও গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে কেউ টাকা পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে ৩৬ জন গ্রাহকের টাকা ফেরত পেতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জমা দেন মতিন। এরপরও সেখান থেকে কোন সদুত্তর মিলছেনা বলে জানান তিনি।
একটু ভালো থাকার জন্য ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের আশায় আর বীমা কোম্পানির লোভনীয় চটকদার কথায় বিশ্বাস করে ফারইস্ট লাইফে পলিসি করেছিলেন ইয়াছমিন আক্তার। দুই লাখ ৯১ হাজার ২২২ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ২০২১ সালে মেয়াদ শেষে এখনো টাকা পাননি। ২০২২ সালের ৬ জুন তার আবেদনের প্রেক্ষিতে কোম্পানীর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আপেল মাহমুদ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বীমার টাকা পরিশোধ করতে নির্দেশ দেন। এরপরও ইয়াছমিন টাকা পাননি।
সেলিম মজুমদার নামে এক চা দোকানদার প্রবাসে থাকাকালে ২০১৭ সালে ১০ বছর মেয়াদী ফারইস্টে তিন লাখ টাকার এফডিআর করেন। পরিবারের প্রয়োজনে উত্তোলন করতে গেলে তিন লাখ ২৫ হাজার ৪৭১ টাকা পেতে ২০২২ সালের ২৯ জুন তার আবেদন প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই আবেদন অনুমোদনের পর জুন মাসের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেন আপেল মাহমুদ। ওই নির্দেশ এখনো কার্যকর না হওয়ায় সেলিম মজুমদার এখনো টাকা পাননি।
শর্শদী ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুর রহিম প্রবাসে থাকার সময়ে ফারাইস্টে ২০১৮ সালে ১৫ বছর মেয়াদী বীমা করেন। চুক্তি অনুযায়ী ৫ বছর পর আড়াই লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও সেটি এক বছর ধরে পাচ্ছেন না।
ফারুক আহমদ নামের এক প্রবাসী জানান, বিদেশের অনেক কষ্টার্জিত টাকা ছেলে-মেয়েদের জীবনের কথা চিন্তা করে সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে বায়রা লাইফে ২০০৭ সালে দুটি বীমা করেন। একটি নিজ নামে ও অপরটি তার স্ত্রী ইসরাত জাহান পপির নামে। যথারীতি কিস্তির টাকাও চালিয়ে যাওয়া হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বীমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর টাকার জন্য অফিসে গেলে বীমা দলিল রেখে দিয়ে সময়ক্ষেপন করে। দীর্ঘদিন অফিসের কর্মকর্তারা গা ঢাকা দেয়। আবার মাঝে মধ্যে একজন কর্মকর্তা বিশাল অফিসের দক্ষিণ পাশে অনেকটা ফাঁকা পরিত্যক্ত অবস্থায় বসে থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য বলেন।
মতিন, ইয়াছমিন ও ফারুকদের মতো হাজার হাজার গ্রাহক সঞ্চয়ের টাকা পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফারইস্ট লাইফের হাজার হাজার গ্রাহকের মেয়াদপূর্তির প্রায় ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধের কথা রয়েছে।
বায়রা লাইফের একটি সূত্র জানায়, কোম্পানীর নামে যেসব জায়গা বা সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে সেই ক্রয় মেমোতে ১০-১২ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। ফেনী অফিসের জন্য এক কোটি টাকা দাম দিয়ে ফ্লোর কেনা হয়। বীমার টাকা ফেরত পেতে হেলাল উদ্দিন, সারমিন সুলতানা, শামীমা আক্তার, ওমর ফারুক, বেলাল হোসেন, শহীদ উল্যাহ, বিবি আয়েশা লিপি, বিবি ফাতেমাসহ শত শত গ্রাহক ধর্না দিচ্ছেন।
সাইফুর রহমান নামে বায়রার এক গ্রাহক জানান, ২০০৮ সালে তিনি বীমা করেন। সেটি মেয়াদউত্তীর্ণ হয় ২০২১ সালে। মেয়াদ শেষে সঞ্চয়ের টাকা না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন। টাকা উদ্ধারে বিভিন্ন লোকের দ্বারস্থ হয়েও কাজ হচ্ছে না। এজন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ ও সুদৃষ্টি কামনা করেন।
বেলায়েত হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে চার বছর আগে মেয়াদ ফুরিয়েছে। এখনও টাকাতো দূরের কথা অফিসে গেলে কর্মকর্তারা সুন্দর আচরন করেন না। এনিয়ে অনেক মানুষ কষ্টে আছেন।
ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহম্মদ হাসান জানান, আম্মুর নামে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বীমা করা হয়। বীমার টাকা পেতে ২০১৯ সালে কাগজপত্র জমা দেয়া হলেও এখনো টাকা আসার খবর নেই।
আবদুল আহাদ নামে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্সে ২০১৫ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৭ সালে কাগজপত্র সঠিকভাবে জমা দেওয়ার পরেও টাকা এখনো পাইনি। উল্টো নতুন করে আরো একটি ইন্সুরেন্স করিয়েছে। ওটার তিন কিস্তি দেওয়া শেষ। তারপরেও টাকা পাওয়ার কোন খবর নেই।
বায়রার উন্নয়ন ও প্রশাসন কর্মকর্তা মোবারক হোসাইন জানান, কোম্পানীর সাময়িক বিপর্যয় হয়েছে। কোম্পানী যে নিয়মে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল সেই নিয়মে পরিচালিত হয়নি। ২০১২ সালে যখন বীমা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় তখন কোম্পানী গ্রাহকদের টাকা না দেয়ার কারনে বীমা কর্মীদের উপর চড়াও হয়। কর্মীরা এলাকায় থাকতে না পারায় মাঠপর্যায়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। মাসে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা কোম্পানীর প্রায় ৭ শতাধিক কর্মকর্তার বেতন দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে সরকার কোম্পানীতে হুমায়ুন কবীর নামে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারিকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে ২০২০ ও ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকার চালায়। উনি প্রশাসক থাকার পর কোম্পানীর আরো ক্ষতি হয়েছে। সরকার কোম্পানীকে এখন আবার সুযোগ দিয়েছে। কোম্পানীতে ৬-৭জন পরিচালক নতুন যোগদান করেছেন। ইতিমধ্যে গ্রাহকদের টাকা দেয়া শুরু হয়েছে।
ফারইস্টের ফেনী ডিভিশনের ইনচার্জ আবদুল হালিম জানান, ফান্ড সংকটের কারণে টাকা পরিশোধে বিলম্ব হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর কোম্পানী বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরের পর গ্রাহকরা টাকা না পাওয়ায় আস্থার জায়গা বেশি নষ্ট হচ্ছে বলেও মিটিংয়ে অবহিত করেছি। তার সুপারিশ করা কয়েকডজন আবেদন জমা রয়েছে বলে তিনি জানান। আশা করছি খুব শীঘ্রই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা যাবে।