দেশে ডলার সংকট চরমে পৌঁছেছে। চাহিদা ও সরবরাহে সামঞ্জস্য না থাকায় দুই বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৮৫ টাকার ডলারের দর এখন ১১০ টাকা। এরপরও বাজারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ী, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসা প্রার্থী সবাই ডলারের জন্য হাহাকার করছেন। সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না। এমনকি ব্যাংক বা অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জগুলো উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসার জন্য বিদেশগামীদের চাহিদা মতো খুচরা ডলারও সরবরাহ করতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচার, বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া এবং মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধের কারণেই এই সংকট তৈরি হয়েছে।
তারা বলছেন, দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। ইতিমধ্যে কিছু প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, এয়ারপোর্টের থার্ড টার্মিনাল, কক্সবাজার এয়ারপোর্ট, ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং যমুনা রেল সেতু উল্লেখযোগ্য। এসব প্রকল্পে বিদেশি ঋণ রয়েছে। ইতিমধ্যেই কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে এসব ঋণের কিস্তি দিতে গিয়ে এখানে বড় অঙ্কের ডলার খরচ হচ্ছে। এ খাতের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার ব্যয় বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের বিদেশে বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও বিদেশে সম্পদের তথ্য সরকারের গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অনুমতি নিয়ে কেউই অর্থ বিদেশে পাঠাননি। এসব অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে। পাচারের কারণেও দেশ থেকে বড় অঙ্কের ডলার চলে গিয়েছে।
যেই পরিমাণ ডলার আছে তাও এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে বাইরে। মূলত ডলারের দাম বাড়াতে একটি চক্র বাজার থেকে প্রচুর ডলার কিনে নিয়েছে। তারা চড়া দামে কার্ব মার্কেটে এ ডলার বিক্রি করছে।
২৩৫টি অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জার থাকলেও এক হাজারের বেশি মানি এক্সচেঞ্জার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই অনঅনুমোদিত এক্সচেঞ্জারগুলোই চড়া দামে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনঅনুমোদিত এক্সচেঞ্জারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এত বড় সিন্ডিকেট ধরতে অভিযান খুবই কম। তাই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামছে না।
মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কেনা এবং সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রির সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে বেশি দামে তারা কেনাবেচা করতে পারবে না। কিন্তু নগদ ডলার এ দামে এক্সচেঞ্জারগুলো বিক্রি করছে না।
অন্যদিকে আরেকটি চক্র হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনছে দেশে। ফলে বিদেশ থেকে বিকাশ বা নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করছে। কিন্তু বিদেশ থেকে ডলার আর দেশে ঢুকছে না।
এদিকে বাজারে ডলারের দাম আরও বাড়বে বলে এক ধরনের গুজব রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষও ডলার কিনে মজুত করে রাখছে। রাজধানীর মতিঝিলের বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে এসব গুঞ্জন রয়েছে। এমনকি অনেকে শেয়ার বিক্রি করে ডলার কিনে রেখেছে।
অন্যদিকে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকেই দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ হলে ডলারের প্রবাহ বাড়ত। সরকার বিভিন্নভাবে বিনিয়োগের চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না হওয়ায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসছে। ব্যাংকে রেমিট্যান্স ১১০ টাকা পাওয়া যায়। অথচ হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠালে মিলছে ১১৮-১২০ টাকা পর্যন্ত। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
তথ্য মতে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৮ হাজার ১০২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন এসেছে ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ মাসে রেমিট্যান্স আসতে পারে ১৪৮ কোটি ডলারের মতো। গেল আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আগস্টে আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এক মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয় আসে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলার। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয় আসে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ, যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে এক হাজার ৫২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আর নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ১৭৭ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের তুলনায় এলসি খোলা ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম ২৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্য ১৩ দশমিক ৭৮ এবং ভোগ্যপণ্যের এলসি নিষ্পত্তি কমেছে শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ। অবশ্য বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাবে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে খরচ কমেছে। যে কারণে এই পণ্যের এলসি প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। এদিকে ডলার সংকটের জন্য এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরাও সরব হয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ডলার সংকটে উদ্বেগ জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক আবদুল হক বলেন, ‘ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলসি নিষ্পত্তি করতে না পারায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে। আবার নতুন এলসি খুলতে না পারায় সরবরাহের অভাবে পণ্যের দাম বাড়ছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না বাড়ায় দৈনন্দিন ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, নির্ধারিত দামে যেন ব্যবসায়ীরা ডলার কিনতে পারেন সেজন্য তারা গভর্নরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের নিয়ে যারা কথা বলেছেন তারা যেন চাহিদা মতো এলসি খুলতে পারেন। ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর উচিত ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে ডলার দেওয়া, যাতে আমদানি ব্যাহত না হয়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা এটা বুঝতে হলে কয়েকটি সূচক দেখতে হবে। এগুলোর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ। বর্তমানে সব সূচকই নেতিবাচক। ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে অর্থনীতি খারাপ হচ্ছে। আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ৪৬ বিলিয়নের রিজার্ভ কমতে কমতে এখন ২১ বিলিয়ন। হয়তো সামনে আরও কমবে। একদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। অন্যদিকে সরকারকে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে। আর অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক আর্শর্বাদে অনেকে অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে। তারাই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত।
অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও বলেন, সরকারের উচিত আর নতুন প্রকল্প না নেওয়া। বিদেশ ভ্রমণ অর্থ ব্যয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এটি কার্যকর হচ্ছে না। শর্ট টার্ম ঋণ নিয়ে ডলারের সংকট কমানো যায়। কিন্তু এতে তেমন কোনো কাজ হবে না। তাই সরকারের উচিত হবে বিদেশি ঋণনির্ভর নতুন প্রকল্প না নেওয়া। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ডলার এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে। ডলারের দাম বাড়াতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ী। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনানুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জারগুলো। ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জারের বাইরে সবগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অন্যথায় খোলা বাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ডলারের রেট বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে না। এটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার এখতিয়ার। তারা তাদের দেওয়া রেট নিয়ে কাজ করেন। ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে সংকট নেই। সাধারণ মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী তারা ডলার সরবরাহও করছে।’