রাজধানী ঢাকায় যত্রতত্র অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে ঘটে বড় বড় দুর্ঘটনা। খোলা ও লিকেজ তারের মাধ্যমেই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বৃষ্টি হলেই ঘটে দুর্ঘটনা। রাজধানীর মিরপুরে সম্প্রতি বিদ্যুতের খোলা তার পড়ে থাকে সড়কে জমে থাকা পানিতে। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় চারদিকে চাউর ওঠে দেশে-বিদেশে।
এর আগে রাজধানীর ওয়ারীতে বৃষ্টির পানিতে বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও একজন। কয়েক বছর আগে গাজীপুরে একটি কারখানায় বৃষ্টির পানি জমেছিল। এতে বিদ্যুতের তার পানিতে পড়লে পুরো কারখানা বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। এতে দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এত মৃত্যুর পরও বেখবর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। থেমে নেই অবৈধ সংযোগ। এছাড়া রাজধানীজুড়ে তারের জঞ্জাল। এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ডিপিডিসি ঝুলে থাকা তার সরানোর কাজ করলেও প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর বস্তি ও ফুটপাতের অধিকাংশ সংযোগ হলো অবৈধ।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের দুর্ঘটনার শিকার প্রধানত সব মানুষই হয়। বিশেষ করে বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ সবই অপরিকল্পিত এবং অরক্ষিত। বস্তির অবকাঠামো যদি বিদ্যুৎ সংযোগের উপযোগী না হয়, তাহলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করতে হয়। অবৈধ সংযোগের পেছনে বিদ্যুতের লোক আছে। অর্থের লেনদেনের ফলে এসব অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়। দুর্ঘটনার দায় যেমন বিদ্যুৎ বিভাগ এড়াতে পারে না, তেমনি সরকারের গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনও এড়াতে পারে না। তাছাড়া নিরাপদ আবাসনের দায়িত্ব সরকারের।
গত বৃহস্পতিবার মুষলধারে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সেই রাতে একই পরিবারের তিনজনসহ মোট চারজনের মৃত্যু হয়। মিরপুর এলাকার কমার্স কলেজের কাছে ঘটনাটি ঘটে। এছাড়া আরও পাঁচ-ছয়জন আহত হয় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে। অনেকের ধারণা, মাটির নিচের বিদ্যুতের লাইন বা ওপর থেকে তার ছিড়ে স্পৃষ্ট হয়েছে। ধারণা, এসব লাইন থেকেই পানি বিদ্যুতায়িত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ এখানকার লাইনগুলো অধিকাংশই অরক্ষিত। এর প্রধান কারণ হলো, অনিরাপদ বিদ্যুৎ সংযোগ।
শুধু এই ঘটনাটিই নয়, ঢাকার প্রায় সব এলাকা বিদ্যুৎলাইনের ঝুঁকিতে রয়েছে। অধিকাংশ অঞ্চলে খুঁটির মাধ্যমে বিদ্যুতের তার নেয়া হয়। আর এগুলো একটি শহরের জন্য খুবই ঝুঁকি বহন করে। যদিও ডিপিডিসি ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকাতে মাটির নিচ দিয়ে সব তার প্রথিত করবে। কিন্তু তারা এখনো আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের লাইন থেকে ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাজধানীতে অগ্নিসংযোগ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। অথচ একটি শহরের নিরাপত্তার জন্য এগুলো হুমকিস্বরূপ। প্রতি বছর রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ও ভবনে বিদ্যুতের লাইন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে।
স্থানীয়রা জানান, সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার পাশের বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে চোরাই লাইনের মাধ্যমে পাশের ঝিলপাড় বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া হয়েছে। মাদ্রাসার দেয়ালের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার নেয়া হয়েছে, যাতে সিমেন্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়া রয়েছে। তারের কিছু অংশ সেই প্রলেপের ওপরও বেরিয়ে রয়েছে। মূলত বৃষ্টির পানিতে তারের এই অংশ ডুবে যায়। সেই দেয়াল ঘেঁষে মিজান স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। মিজানের কোলে ছিল মেয়ে লিমা, আর স্ত্রী মুক্তার কোলে ছিল ছেলে হোসাইন। মাদ্রাসার দেয়ালের শেষপ্রান্তে আসতেই তারা পানিতে ছটফট করতে থাকেন। দূর থেকে অনেকেই এ ঘটনার ভিডিও করতে থাকেন। সে সময় অনিক নামের ওই তরুণ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। এ সময় তিনিও বিদ্যুতায়িত হন। তবে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলীর দাবি, তারা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছেন, মূল বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়েনি বা সেখান থেকে পানি বিদ্যুতায়িত হয়নি। তিনি মনে করেন, বস্তির কোনো লাইন থেকে এটা হতে পারে।
মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারজনের মৃত্যুতে বিদ্যুৎ বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করে। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ফায়ার সার্ভিস থেকে মিরপুরের হাজী রোড এলাকায় দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক রূপনগর বি ও বি (ডেসকো) বিভাগের আওতাধীন রূপালী হাউজিং ও রূপনগর ফিডার বন্ধ করে দেয়। বৃষ্টির মধ্যেই দ্রুত পরিদর্শন টিম (গ্যাং ) পাঠালে দেখা যায় ওই এলাকার রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। পরিদর্শন টিম কর্তৃক সমস্ত এলাকা পরিদর্শন করে কোনো এলটি/এইচটি লাইন ছেঁড়া বিদ্যুতের তার পায়নি। পরে রাত ১১টা ২৭ মিনিটে বন্ধ ফিডার লাইন চালু করা হয়। এর আগে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিদ্যুৎচালিত মটরের পানিতে গোসল করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মাহি আক্তার ও বিন্দু আক্তার নামে ৯ বছর বয়সি দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে বৃষ্টির পানিতে হেঁটে যাওয়ার সময় রাজধানীর কমার্স কলেজ সংলগ্ন হাজীপাড়া সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যুর ঘটনার পর গতকাল শনিবার বিদ্যুৎ বিভাগের একটি দল ঘটনাস্থল সংলগ্ন অবৈধ বিদ্যুতের তার উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করে। ঝিলপাড় হাজীপাড়া সড়কের সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এর পাশে মুক্তা ফার্মেসির মধ্যবর্তী দেয়াল বেয়ে নামানো অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন। আর সামাম্য দূরেই শাহজাহান ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিকসে এ দেয়াল সংলগ্ন অবৈধ বিদ্যুতের লাইনও উচ্ছেদ করা হয়। দেয়ালে প্লাস্টার ভেঙে ও ড্রেনের নিচ থেকে এসব লাইন কাটা হয়। শাবল, হাঁতুড়ি দিয়ে প্লাস্টার ভেঙে কাটা হয় বিদ্যুতের অবৈধ লাইন। ড্রেনের নিচ থেকে কাটা হয় অবৈধ বিদ্যুতের লাইন।
এ বিষয়ে নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আসল সমস্যা হলো, একটি রাজধানী শহরে বৃষ্টি হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও পানি না সরাটা খুবই দুঃখজনক। তাছাড়া বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে মানুষ মারা যাওয়াটা কখনো আশা করা যায় না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়াটা সম্পূর্ণ একটি দুর্ঘটনা। এটা মূলত কর্তৃপক্ষের অসচেতনতার ফলে হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কয়েকদিন পরপর তাদের উচিত খোঁজ নেয়া। যাতে কোনো ধরনের বিপদ তৈরি হতে না পারে। ডিপিডিসির অধীনে সব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অধীনে আন্ডাগ্রাউন্ডের ব্যবস্থা করা হবে। এখন থেকে ভূগর্ভস্থ ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে। যা খুবই নিরাপদ হবে। বিদ্যুতের তার উপরে থাকলে ছিঁড়ে যাওয়া, ট্রান্সমিটার ব্রাস্ট হওয়া, খুঁটি ভেঙে যাওয়ার কারণে অগ্নিসংযোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ডেসকোর সম্পূর্ণ অবৈধ লাইন থেকে এই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে থাকে। বিভিন্ন বস্তিতে মাটির নিচ দিয়ে অবৈধ লাইন থেকে এমনটা হয়। বৃষ্টির পানির সাথে বিদ্যুৎ লাইনের লিক হওয়ার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সিটি করর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সবার সাথে কথা বলা হয়েছে ঠিক মতো সংযোগ দেয়ার জন্য। তারা তো কোনো নিয়ম মানছে না।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক মোরশেদ আলম খান বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের মাধ্যমে বিভিন্ন বাসায় বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হবে। তবে সব জায়গায় এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে তার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মানুষের নিরাপত্তার জন্য অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্ট করা হচ্ছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। যখনই বৃষ্টি বা ঝড়ের আভাস পাচ্ছি তখনই সবাইকে সচেতন করা হচ্ছে। লাইন ছিঁড়ে যাওয়াটা দুর্ঘটনা ছাড়া তেমন কিছুই না।
ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলী বলেন, আমরা বস্তিতে ১০টি ঘরের জন্য একটি লাইন ও মিটার দিই। ওই ১০টি পরিবার একসঙ্গে লাইনটি ব্যবহার করে। আমাদের দায়িত্ব সংযোগ দেয়া মিটার পর্যন্ত। ভেতরের বিষয় আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। স্থাপনার কারণেই তাদের লাইন দুর্বল থাকে। আমরা ধারণা করছি, ওই লাইন ছিঁড়ে বা লিক হয়ে পানি বিদ্যুতায়িত হয়েছে।
বস্তিতে অবৈধ লাইনের বিষয়ে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাওসার আমীর আলী বলেন, অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাই। ওই বস্তি অনেক ঘিঞ্জি, সবসময় লাইন দেখভাল করা যায় না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ যদি অবৈধ সংযোগ দেয়ায় যুক্ত থাকে, তাহলে প্রমাণসাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।