ডিজিটাল ফাঁদের রকমফের

মির্জা মেহেদী তমাল

সময়ের সঙ্গে বাড়ছে প্রতারণার ধরন, বাড়ছে প্রতারকের সংখ্যা। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেট, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এই চক্র বেড়েই চলছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন ব্যক্তির আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা, অশ্লীল লিংক ছড়িয়ে ব্যবহারকারীকে বিব্রত করা, কারও ফেসবুক বা ই-মেইল আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি করা, মোবাইলে লটারি জেতার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ প্রতারক চক্র বিভিন্নভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। সাধারণ মানুষ অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না ওদের প্রতারণার কৌশল। এ ছাড়া ওয়েবসাইট, নিউজ পোর্টাল তৈরি, আউটসোর্সিং, ইউটিউবে অ্যাকাউন্ট করে আয়ের প্রলোভন ও ফেসবুক লাইক বিক্রির নামেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বৈধভাবে আয়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে চটকধারী বিজ্ঞাপন দিয়ে বেকার-তরুণ যুবকদের কাছ থেকে কৌশলে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ বৈধভাবেই আউটসোর্সিংসহ ইন্টারনেটে যেসব আয়ের পথ রয়েছে প্রতারকরা সে উপায় না দেখিয়ে ভ্রান্তপথে নগদ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ছে। এভাবে প্রতিদিন অসংখ্য ব্যক্তি প্রতারিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে লজ্জিত হয়ে বিষয়টি চাপা দেওয়ায় প্রতিকারও পাচ্ছেন না।

এ ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, ইন্টারনেটের বৈধ ব্যবহারকে যারা প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যথাযথ অভিযোগ পাওয়া গেলে এদের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওয়েব পোর্টাল নির্মাণের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, আউটসোর্সিং ও ফেসবুক লাইক বিক্রি চক্রের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসছে। এ ধরনের কয়েকটি চক্রের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আরও কয়েকজনকে খুঁজছে গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, দ্রুত সময়ে এবং কম টাকায় নিউজ পোর্টাল বা ব্লগ তৈরি করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ফেসবুকে, মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়ে প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয়ে পোর্টালের আংশিক কাজ করে ঝুলিয়ে রেখে আরও কয়েকগুণ টাকা দাবি করা হয়। বাড়তি টাকা না দিলে বা চাহিদামতো টাকা না পেয়ে কাজ ঝুলিয়ে রেখে হয়রানি করা হয়। এ ছাড়াও ‘সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের’ (এসইও) নামে আরও টাকা দাবি করা হয়। ওয়েবসাইটের আ্যলেক্সা র‌্যাংকিংয়ের নামে ‘এসইও’ করার কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অনেক অভিযোগ আছে। টাকা বেশি দিলে সাইটের র‌্যাংক কমবে এমন প্রতিশ্রুতির পর গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা আদায় করারও অভিযোগ আছে।

একাধিক স্বনামধন্য নিউজ পোর্টালের কর্ণধার জানান, বর্তমানে ওয়েব ডেভেলপারের নামে দেশে ‘চিটার’-এর সংখ্যা বাড়ছে। এদের অধিকাংশই ডেভেলপারের কাজে অনভিজ্ঞ। সামান্য বিদ্যার্জন করেই প্রতারণা করে অল্প সময়ে বেশি আয়ের লোভে পড়ে। তারা শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকেও হয়রানি করছে বলে জানা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে টাকা লুটেরও ভুল পথ খুঁজে দিচ্ছে তারা। আর এসব ফাঁদে পা দিয়ে প্রশাসনের কয়েকটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা সমস্যায় রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কলাবাগান, ধানমন্ডি, কাওরানবাজার, আর কে মিশন রোড, মালিবাগ, উত্তরা এলাকায় গড়ে উঠছে কয়েকশ ডিজিটাল প্রতারক চক্র। তাদের নেই নির্দিষ্ট ঠিকানা, অফিস থাকলেও কয়েক দিন পরপরই পরিবর্তন করে থাকে। শুধু ল্যাপটপ ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমেই চলে এদের কাজ।

আউটসোর্সিং : এমন একটি শব্দ যেটি শুনলেই মনের গহিনে এক অজানা ভয় কাজ করে। টিভি চ্যানেলের সামনে বসলে কিংবা পত্রিকার পাতা খুললেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ঘরে বসেই বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে টাকা ও ডলার উপার্জনের প্রতারণাপূর্ণ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন দেশের লাখ লাখ যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি গড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পৌঁছে গেছে এসব প্রতারকের কালো থাবা। অল্প সময়ে কম বিনিয়োগ ও শ্রমের বিনিময়ে ঘরে বসে মোটা টাকার মালিক হওয়ার লোভে দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেকার যুবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অর্থ ও মেধা নিয়ে। তবে তাদের শর্টকাটে বড়লোক বনে যাওয়ার অঙ্কুরিত স্বপ্ন আর পল্লবিত হতে পারেনি। লাখ লাখ বেকার যুবকের কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রতারকরা এরই মধ্যে সটকে পড়ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রতারক তাদের বাড়িঘর ফেলে গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আত্মগোপন করেছে। এসব অনলাইন প্রতারণার বিষয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক আগে অবহিত করার পরও তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। প্রযুক্তিবিদরা বলেন, সামাজিক মিডিয়ার অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের কোনো ফরেনসিক ল্যাব গড়ে ওঠেনি। এ জন্য ফেসবুকে সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য দেশে যে আইন রয়েছে সেটিও বিশেষায়িত নয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে।

Others শীর্ষ সংবাদ