বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত এপ্রিলে তিনি বলেন, ”তারা গণতন্ত্রকে মিটিয়ে দিয়ে এমন একটি সরকার গঠনের চেষ্টা করছে যার গণতান্ত্রিক অস্তিত্বই থাকবে না”। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের তিরস্কারের মুখে পড়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ভালো করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসন্তোষের খবর আমেরিকার রাজনৈতিক মহলে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন গত জুন মাসে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছিলেন; বিষয়টি নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার আশ্বাস দিয়েছে, তর্কও করেছে। বাণিজ্য ও নীতির সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই “গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ”-এর একতরফা অভিযোগ তুলে একটি দেশ বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে থাকে। একই সময়ে, বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা দেশের প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার ভিডিও প্রমাণ ব্লিঙ্কেনের কাছে পাঠিয়ে এস্টাবলিশমেন্ট ও বিরোধী দলের সদস্যদেরও নতুন আমেরিকান ভিসা নীতির আওতায় আনার অনুরোধ জানিয়েছেন। এটাকে ভণ্ডামি হিসেবে দেখা যেতে পারে কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারি প্রতিনিধি গণতন্ত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রকৃত বাধা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন নন, যতক্ষণ না সেটা বিরোধী দল সৃষ্ট হয়ে থাকে।
‘বাণিজ্য এবং রপ্তানি’ যেখানে সরকারগুলোর মধ্যে আলোচনার অন্যতম বিষয়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে শান্ত করতে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে ঢাকাকে। এর পাশাপাশি কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তনের অভিপ্রায়ে অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগও করা য়য়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। একই বছর, যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।
বিজ্ঞাপন
চলতি বছরের শুরুর দিকে আমেরিকার জ্যেষ্ঠ পররাষ্ট্র কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু ঢাকায় এসে বলেছিলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে, র্যাব- এর উপর তা আধিপত্য বিস্তার করেছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসলামি জাতিটির কঠোর সমালোচনা করার সময় ধর্মীয় মৌলবাদকে কোনো ইস্যু বলে মনে করছে না আমেরিকা। দেশের মন্দিরগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ, হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পেলেও আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কথা বলছে। এটি লক্ষণীয় যে প্রিয়া সাহা নামের এক হিন্দু নারী ২০১৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সামনে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের কথা তুলে ধরার সুযোগ পেলেও নিজ দেশেই তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মুখে পড়েন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের পদক্ষেপকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে বাদ দিয়ে দেন। বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছিল এবং বৈরিতার তুলনায় সম্পৃক্ততা কম ছিল। ২০২০ সালে মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তন নতুন জটিলতা নিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর মুখে সরকার পরিবর্তনের অভিযোগ খুব কমই শোনা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র এখন রাজনৈতিক নিপীড়নের আরও প্রমাণ হিসেবে বাংলাদেশের বিরোধী দল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর অভিযোগকে গুরুত্ব দিচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক সত্তা যখন একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধীদের কথা বলার ওপর ফোকাস করে তখন তাকে বিদেশি হস্তক্ষেপের সাথে তুলনা করা হয়। বিশ্বজুড়ে “কালার রেভুলেশনে” আমেরিকার জড়িত থাকার কথা বিবেচনায়, এটা অসম্ভাব্য নয় যে গণতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের মাটিতে অনুরূপ প্রচেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা করে। নয়াদিল্লিতে সম্প্রতি শেষ হওয়া জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে তোলা সেলফিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের ছবি নিয়ে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট দেখা গেছে। যদিও উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যাচ্ছে না।
বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগের কারণে উভয় দেশের মধ্যে বিবাদ বাংলাদেশকে তার বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার চীনের আরও কাছাকাছি আসতে সহায়তা করবে বলে অনেকে মনে করেন। শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্ব সুপরিচিত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকাকে প্রতিস্থাপন করার মতো অবস্থানে নেই ভারত। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য এই সময়ে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। যদিও প্রতিবেশি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য শেখ হাসিনা ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন বলে জানা গেছে।
বর্ধিত সংযোগ, বাণিজ্য এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ভারতীয় প্রশাসনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছে। স্থিতিশীল ভারতীয় উপমহাদেশ গড়ে তুলতে অ-মৌলবাদী হাসিনা সরকার সাহায্য করেছে, চীনা অনুপ্রবেশ মোকাবেলায় যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বাস করে যে, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার সুযোগ ছাড়া উচিত নয়, এমনকি এই অঞ্চলে অব্যাহত চীনা যুদ্ধের মুখেও।
ইতিহাসে দেখা গেছে ‘পুতুল সরকারগুলো’ দীর্ঘমেয়াদে কেবল পশ্চিমা কর্পোরেটদেরই উপকারে আসে। নাগরিকদের উদ্বেগ মোকাবেলা করার উপায় থেকে বঞ্চিত করা হয়, এবং সমগ্র দেশ দারিদ্র্য কিংবা যুদ্ধ অথবা উভয়ের সাক্ষী হয়ে থাকে।
গণতন্ত্র হলো জনগণের ইচ্ছার প্রয়োগ নিশ্চিত করার একটি প্রচেষ্টা এবং এটি শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তিতেই হতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী একটি জাতি বিশ্বের একটি সার্বভৌম গণতন্ত্রের নির্বাচনকে অবমূল্যায়ন করতে তাদের বিশাল কূটনৈতিক, মিডিয়া এবং বাণিজ্য ক্ষমতাকে বেছে নেয়, তবে সেটি গণতন্ত্রকে বশীভূত করার প্রয়াস হিসেবে দেখা হবে। সমস্ত গণতন্ত্রই অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট কার্যকরী গণতন্ত্রের একটি মূল্যবান উদাহরণ হলেও দেশটি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক জোটের পক্ষপাতী হয়ে মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্ব দাবি করতে পারে না।
বাংলাদেশের জনগণের অধিকার রয়েছে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের নেতা নির্বাচন করার। ২০২৪ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার আশ্বাসের প্রতি বিশ্ব নজর রাখবে। কিন্তু, এ সময় আমেরিকার হস্তক্ষেপকে সরকার পরিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট হুমকি হিসেবে দেখা হবে।
[লেখক: উপরোক্ত মতামতটির লেখক সাগরিকা সিনহা একজন কলামিস্ট এবং পডকাস্টার। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। লেখাটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি’তে গত ২২ সেপ্টেম্বর ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে]মানবজমিন ডিজিটাল